করোনাকালে সারাবিশ্ব ও তার মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তা সত্ত্বেও চিরাচরিত নিয়মে চান্দ্র মাসের হিসাবে ঈদুল আজহা আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব এটি। তবে এটি শুধু আনন্দের নয়, এখানে আত্মত্যাগের মহিমা ও নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে সমর্পণ করার যে ইতিহাস তা সকলেরই জানা। তাই আমি হজরত ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ) এর যে কাহিনি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা বিস্তারিত বলবো না। শুধু ওই ঘটনার মধ্যে কি শিক্ষা অন্তর্নিহিত ছিল তা নিজের মতো করে বর্ণনা করবো।
কোরবানি শব্দের অর্থ বা শানেনুযুল জানা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। কোরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তাঁর প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ: আয়াত ৩৪)।
কোরবানি শব্দের আভিধানিক অর্থ কি? আরবি করব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দু ও ফার্সিতে (قربانى) কোরবানি নামে রূপান্তরিত। এর অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরআনুল কারিমে কোরবানির একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।>>نحر অর্থে। আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কোরবানি আদায় করুন। এ কারণে কোরবানির দিনকে يوم النحر বলা হয়। >> نسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ’ম: আয়াত ১৬২)>> منسك অর্থে। হাদিসের ভাষায় অর্থে কোরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদুল আজহা’ বলা হয়।
কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশনা এ রকম যে, কোরবানি হলো আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য মাধ্যম। কোরবানির শুরু হয়েছিল হজরত আদম (আঃ) দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে সংঘটিত কোরবানির মাধ্যমে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সুরা মায়েদা: আয়াত ২৭-২৮)। এ হলো কোরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা কোরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।
কোরবানির প্রচলন হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু হলেও মুসলিম উম্মাহ কোরবানি মূলত হজরত ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় হজরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা। আল্লাহ তা’আলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় ফেলেছিলেন এ কোরবানির নির্দেশ প্রদান করে, যা তিনি হাসিমুখে পালন করে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যখন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১২৪)
কোরবানির প্রচলন, এর প্রয়োজনীয়তা এবং কেন এই কোরবানির প্রচলন আর তা হলো; হজরত ইসমাইল (আঃ) যখন চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন; তখন হজরত ইবরাহিম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানির জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হন। আর নবীদের স্বপ্নও কোনো কল্পনাপ্রসূত ঘটনা নয় বরং তা ‘ওহি’ বা আল্লাহর প্রত্যাদেশ। তখন হজরত ইবরাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইলকে বললেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি? সে (হজরত ইসমাইল (আঃ) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফফাত: আয়াত ১০২)
সবাই জানি কোরবানির জন্য আল্লাহর হুকুমপ্রাপ্তির সময় হজরত ইবরাহিম (আঃ)তখন ৯৯ বছরের বৃদ্ধ। তিনি ও তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে আত্ম-নিবেদনে আল্লাহ তা’আলা উভয়কে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন। আর তিনিও মিনা প্রান্তরে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে কোরবানির সে নির্দেশ পালন করেছিলেন। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তাঁর মানসিকতা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গিয়েছিল। যা আজও মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ তিন দিনের যেকোনো একদিন পালন করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কোরবানির প্রচলন করেননি। বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করার শিক্ষা দিয়েছেন। কোরবানির মাধ্যমে নিজেকে মুত্তাকী ও পরহেজগার হিসেবে তৈরি করার তাওফিক ও সক্ষমতা দান করুন।
কোরবানির উদ্দেশ্য ও শিক্ষা
প্রত্যেক মানুষ শিরকমুক্ত ইবাদত করবে এটাই মহান আল্রাহর বিধান বা হুকুম। ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী মহান রাব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে সে শিক্ষাই দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: ‘বলুন: নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, কোরবানি শুধু আল্লাহর উদ্দেশেই হতে হবে। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশে নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য-চেহারা এবং ধনসম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। সুতরাং, কোরবানির পূর্বেই কোরবানিদাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে।’
মহান আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কোরবানিকে পরবর্তী মানুষের জন্য অনুসরণীয় করে দেন। অর্থ-সম্পদ, টাকা পয়সা, আল্লাহর রাস্তায় কীভাবে ব্যয় করতে হয় তা মানুষকে বুঝাতে ও শিখাতে এই কুরবানির প্রচলন চালু হয়ে যায়। এমনকি প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও যেন মানুষের কোনো দ্বিধা, সংশয় না থাকে। তাছাড়া কোরবানি আত্মত্যাগের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। মানুষের ষড়্রিপু তথা হিংসা, লোভ, কাম, ক্রোধ, ত্যাগের মাধ্যমে মনের পশুবৃত্তি তথা কুপ্রবৃত্তিকে জবাই করতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে ধনলিপ্সা, লোভ-লালসা, জাগতিক কামনা-বাসনা এবং দুনিয়া প্রীতিকে কোরবানি করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জন করা কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিবদের মাঝে বিতরণ করা সুন্নত ও অতি উত্তম আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: সে প্রকৃত মোমিন নয় যে নিজে পেট পুরে খায়; কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (তিরমিজি)।
কিন্তু আমরা কি দেখছি মানুষ এখন তার জীবন-যৌবন পার করে দিচ্ছে দুনিয়াতে তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের পেছনে। রিজেন্টের সাহেদ, জেকেজির আরিফ ও ডাঃ সাবরিনা-এরা সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পরে নিজেদের মেধাকে প্রতারণা ও অপকর্ম করার কাজে ব্যয় করছে। তারা তাদের দক্ষতাকে নীতিহীন ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে সততাকে ভুলে গিয়ে যার পরিণতি তারা ভোগ করছে। এরা তাদের মেধাকে কোরবানি করলো কিন্তু খারাপ দিকে। তাদের এই নীতিহীন মেধা আমাদের না কোনো কাজে আসছে এবং তাদেরও না কোনো কাজে লাগছে। এই তো জীবন। কি হবে এতো অর্থ যা মৃত্যুকালে কোনো কাজেই আসবে না। কোরবানির পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের যে পশুত্ব সেটা কুরবানি না দিতে পারলে আমাদের সব শিক্ষা ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
আমাদের কোরবানির শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। মনের পশুত্বকে বিসর্জন দিতে হয় কিভাবে তা শিখতে হবে। কিন্তু ধ্রুবসত্য হলো আমরা কোরবানির যে প্রকৃত শিক্ষা তা মুসলিম হিসাবে গ্রহণ করতে পারিনি। বরং নীতিগত শিক্ষায় ও নৈতিকতার উৎকর্ষে নিদারুণভাবে দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। কুকর্মে ও অন্যায় কাজে নিজের জীবন-যৌবন কোরবানি করছি। কোনো ভালো কাজে বা ত্যাগে নিজেকে সমর্পণ করছি না। সেকারণে আমাদের উপর সৃষ্টিকর্তা নাখোশ হয়ে গেছে। বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, জলোচ্ছ্বাসসহ নানারকম আজাব গজব প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে। কোভিড-১৯ সেটারই প্রতিফল কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। বেশি বেশি কুরবানির মাধ্যমে পাপমোচনের জন্য সবার এই করোনাকালে প্রার্থনা করা উচিত।
নিজের যা আছে তা ভালো কাজে উৎসর্গ করার মাঝে যে স্বর্গীয় সুখ তা শুধু দুনিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আখিরাতেও পাথেয় হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা শুধু গরু-ছাগল কোরবানি করে গোশত খাওয়াকে ঈদ বানিয়ে নিলাম, কাজের কাজ কিছুই হলো কি? মনে হয় হয়নি, তাহলে এতো এতো দুর্নীতিবাজ, প্রতারক, চোর-বাটপার এবং মুখোশধারী পয়দা হতো না এবং পর্দা, বালিশ, মাস্ক কাণ্ড দেখতে হতো না। যাহোক আমরা অন্তত এই করোনাকালে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতিজ্ঞা করতে পারি, আমরা কোনো দুর্নীতিবাজ ও প্রতারক লোক হতে চাই না। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রতারক, ত্রাণ ও চাল চোর তাদেরকে বর্জন করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে শুধু কুরবানি এলে নয় বরং সবসময়ই মনের পশুত্বকে কোরবানি দিবো এই শপথে বলিয়ান হই।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট। ইমেইল