অ্যাডভোকেট আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
অপরাধ যেখানে আইন সেখানে। অপরাধ করলে আর তা প্রমাণিত হলে আইনে যেমন অপরাধীকে সাজা দেয়া হয় ঠিক তেমনি তাকে আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়া হয়। আইনে এমনই একটি সুযোগ আছে যাকে বলা হয় সাফাই সাক্ষী।ইংরেজিতে Define Witness…আসুন জেনে নেই সাফাই সাক্ষীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
“ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী কোনো মামলা অনুসন্ধান বা আদালতে মামলা বিচারকালীন সময়ে অভিযুক্ত আসামীকে বা মামলার আসামীকে তার নিজ সম্পর্কে সাক্ষ্য অর্থাৎ আত্নপক্ষ সমর্থন করে যে সাক্ষ্য অথবা আসামী বা অভিযুক্তের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করাকে সাফাই সাক্ষী বলা হয়।”
ফৌজদারী কার্যবিধি- ৩৪২ ধারা।
◾সাফাই সাক্ষীর স্বাভাবিক কার্যক্রম নিম্নরূপঃ
০১. আদালত যে কোনো সময়ে পূর্ব সতর্কতা ব্যতীত সাফাই সাক্ষী গ্রহণ করতে পারেন।
০২. সাফাই সাক্ষীতে অভিযুক্ত আসামী তার বিরূদ্ধে প্রদত্ত সকল প্রকার সাক্ষ্যর ব্যাখ্যা করতে পারে।
০৩. অভিযুক্ত আসামী কর্তৃক প্রদত্ত সাফাই সাক্ষীতে যদি কোনো প্রকার অপরাধের সূত্র পাওয়া যায় তাহলে আদালত তা অনুসন্ধান করে তার বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
০৪. সাফাই সাক্ষীতে অভিযুক্ত আসামী কোনো তথ্য অস্বীকার বা মিথ্যাচার করলে তার জন্য কোনো প্রকার শাস্তি প্রদান করা হয় না।
০৫. আদালত সাফাই সাক্ষীতে আসামীকে মামলার সাথে প্রাসঙ্গিক যে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন।
০৬. সাফাই সাক্ষীতে প্রদত্ত তথ্যাদি থেকে সম্মানিত আদালত যে কোনো ন্যায়সঙ্গত অনুমান করতে পারেন।
০৭. সাফাই সাক্ষীতে আসামীকে শপথ গ্রহণ করানো হয় না। (ফৌজদারী কার্যবিধি- ৩৪২ ধারা – ‘আসামীর জবানবন্দি গ্রহণ করার ক্ষমতা ‘ এর
আলোকে লেখা হয়েছে)
এবার একটু Details এ আসা যাক।। সাফাই সাক্ষীর আদ্যোপান্ত বুঝতে হলে আমাদের CrPc এর ধারা ৩৪২ এর সাথে ৩৪০ ধারাও ভালো ভাবে আত্নস্থ করতে হবে কারণ ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা-৩৪০ এবং ধারা-৩৪২ এই ধারাগুলোকে আমরা প্রায় সময়ই Mingle (গুলিয়ে) করে ফেলি।আজ আমি পাঠকের সুবিধার্থে খুব সহজবোধ্য আলোচনার মাধ্যমে দুটি ধারার মূল পার্থক্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
৩৪০ ধারাঃ এ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়ার পর আসামী আত্নপক্ষ সমর্থনে নিজে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করবে। আসামীর আবেদনের ভিত্তিতে আদালত আসামীর সাফাই সাক্ষ্য নিবেন।
৩৪২ ধারাঃ এ ধারা অনুযায়ী আদালত স্বপ্রণোদিত (suo motu) হয়ে আসামীর সাক্ষ্য নিবেন। এটা আদালতের দায়িত্ব। ৩৪২ ধারা অনুযায়ী সাফাই সাক্ষী দেয়ার জন্য আসামী আদালতে আবেদন করবে না। আদালত নিজে ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামীর সাক্ষ্য নিবেন। ৩৪০ ধারার সাথে ৩৪২ ধারার কোন সম্পর্ক নেই। দুটি ধারাতে আলাদা কথা বলা হয়েছে। ৩৪০ ধারা অনুযায়ী সাফাই সাক্ষী নেয়া হলেও আদালত ৩৪২ ধারা অনুযায়ী স্বেচ্ছা প্রণোদিত( suo motu) হয়ে আসামীর বা তার পক্ষ থেকে অন্য কারো সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।
এ বিষয়ে আরো একটু Transparent idea
নেয়া যাক।
মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ সব শেষ হওয়ার পর আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আদালতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তারপর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানীর পর আদালত রায় প্রদান করবেন।এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের কিছু Decisions (সিদ্ধান্ত)আছে যেগুলো না উল্লেখ করলেই নয়। যেখানে বলা হয়েছে, “অভিযোগকারী পক্ষের সকল সাক্ষ্য প্রমাণ শেষ হওয়ার পর আসামীর বিরূদ্ধে যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ এসেছে সে সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা বা বক্তব্য আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে গ্রহণ করা বাধ্যকর।”[32 BLD(HCD)113]
However, ৩৪২ ধারায় জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আসামীর বক্তব্য Evidence Act এর ধারাঃ ৩ অনুযায়ী সাক্ষ্য (evidence) হিসেবে গণ্য হবে না।
তবে আসামীর বক্তব্য অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের সঙ্গে বিবেচনা করা যাবে। ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামীর বক্তব্য অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত কিনা সেটাও আদালত বিবেচনা করতে পারবেন।
[10 BCR(AD)203] অর্থাৎ ইহা আদালতের বিবেচ্য বিষয়।
Again, ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আদালত আসামীর বক্তব্য নেয়ার সময় সাক্ষীরা আসামীকে জড়িত করে যেসব বক্তব্য রেখেছে সেগুলো আসামীর নজরে আনতে হবে। সাক্ষীদের বক্তব্য আসামীর নজরে আনার প্রধান কারণ হল আসামী যেন তার অবস্থান সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক ,”যদি কোনো সাক্ষী আসামীর নিকট হতে কোনো আলামত উদ্ধারের বিষয়ে বক্তব্য রাখে তাহলে ঐ বক্তব্যটি আসামীর নিকট সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।”
এক্ষেত্রে আসামীকে জড়িত করে সাক্ষীদের বক্তব্য আদালত আসামীর নজরে আনবেন। তবে এরকম হলে আদালতকে যে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো আদালতকে দেখতে হবে,আসামীকে জড়িত করে সাক্ষীর বক্তব্য আসামীর নজরে আনা না হলে আসামীর ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে কিনা? যদি আসামীর ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে আদালত আসামীকে জড়িত করে সাক্ষীর বক্তব্য আসামীর নজরে না আনলেও সেটা আদালতের কোনো ত্রুটি(Fault) হিসেবে বিবেচিত হবে না।
In fact, রায় ঘোষণার পূর্বে আদালত যদি দেখতে পান ৩৪২ ধারায় আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে ত্রুটি (Fault)রয়েছে তাহলে সঠিকভাবে আসামীকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এমনকি যদি আপীল আদালতেও এমন ত্রুটি (Fault) ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে আসামীকে খালাস দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে মামলাটি বিচারিক আদালতে ফেরৎ দিয়ে সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিতে হবে।
[11 BLT(AD)92]
উপরের আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪০ ধারা অনুযায়ী আসামী নিজে অথবা তার পক্ষে অন্য কেউ আদালতে আবেদন করে সাফাই সাক্ষী দিতে পারবে। আর ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আদালত স্বতঃপ্রবৃত্ত (suo motu) হয়ে অর্থাৎ স্বেচ্ছায় আসামীর সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।
আয়েশা সিদ্দিকা লোপা, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী