সব
facebook apsnews24.com
বিবাহিত পুরুষের যাতাকল - দেনমোহর ও বাস্তবতা - APSNews24.Com

বিবাহিত পুরুষের যাতাকল – দেনমোহর ও বাস্তবতা

বিবাহিত পুরুষের যাতাকল – দেনমোহর ও বাস্তবতা

মতিউর রহমান

বাংলাদেশী আইনে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারিবারিক বিষয়গুলো তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যেমন- উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লীষ্ট আইনের মূল ভিত্তি হল ধর্মীয় বিধান। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিঞ্চিৎ সংশোধন করে Statute বা বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করেছে। এই ধর্মীয় আইনের অন্যতম অনুসঙ্গ- দেনমোহরের অপব্যবহারে পুরুষ নির্যাতন, পুরুষের জীবন দুর্বিষহ করা ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। মূল আলোচনায় থাকছে –
১) দেনমোহর কী ও কেন,
২) দেনমোহর স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর উপর যৌতুকের সমতুল্য কিনা,
৩) দেনমোহরের প্রকারভেদ,
৪) পরিশোধের উপায়,
৫) দেনমোহরের পরিমাণ কীসের উপর নির্ভর করা উচিৎ,
৬) অপব্যবহারে পুরুষের জীবন দুর্বিষহের কিছু সত্য ঘটনা,
৭) তার সম্ভাব্য সমাধান এবং
৮) Out of the box পর্যালোচনা।

ইসলামী শরীয়াহ আইনে বিবাহের অন্যতম মৌলিক শর্ত হল স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা। দেনমোহর হল কিছু সম্পদ বা টাকা যা বিবাহের শর্তস্বরূপ স্ত্রীকে absolutely প্রদান করতে হয়। অবশ্য অর্থ বা সম্পদ প্রদানে অপারগ হয়ে হাদিসে কুরান শিক্ষাকে দেনমোহর হিসেবে ধরে বিবাহের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। সূরা আন নিসার আয়াত নং ৪ এবং ২৪ এ স্বামীদের প্রতি খুশিমনে স্ত্রীকে নির্ধারিত দেনমোহর প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদিসে আরো বলা হয়েছে যে স্বামীর দেনমোহর প্রদানের ইচ্ছা নেই, সে ব্যাভিচারী (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩)। অর্থাৎ পাপী।

অনেকে দেনমোহরকে স্বামীর উপর এক প্রকার যৌতুক হিসেবে দাবি করতে চান। কিন্তু শরীয়াহ, রাষ্ট্রীয় আইন এবং প্রথা অনুযায়ী দেনমোহর এবং যৌতুক এক নয়। যৌতুক নিরোধ আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, “…যৌতুক অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত হওয়া কোন সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত- (ক) বিবাহের এক পক্ষের দ্বারা বিবাহের অপর পক্ষের প্রতি, অথবা (খ) বিবাহের সময় বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোন সময় উক্ত পক্ষগণের বিবাহের প্রতিদান হিসাবে বিবাহের যে কোন পক্ষের মাতা-পিতা দ্বারা বা অপর কোন ব্যক্তির প্রতি, কিন্তু যে ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়ত) প্রযোজ্য তাহাদের ক্ষেত্রে যৌতুক বা মোহর অন্তর্ভূক্ত করে না।”
এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ২(ঞ) এ যৌতুকের অনুরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তবে এই ধারায় কণে পক্ষ কর্তৃক বর পক্ষের থেকে দাবিকৃত অর্থ বা সামগ্রীকে যৌক্তুকের সংজ্ঞায় আনা হয়নি। তাই এই দুই আইনের দুইটি ধারা মিলিয়ে পড়তে হবে।

দেনমোহরের প্রকারভেদঃ
পরিশোধের সময়ের উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দুই প্রকার। যথা-
১) Prompt বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর যা স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বে বা স্ত্রী যখন তলব করবে, তখনই পরিশোধ করতে হবে, এবং
২) Deferred বা বিলম্বিত দেনমোহর যা দুটি পরিস্থিতিতে প্রদানে বাধ্য থাকতে হয়।
a) যদি স্বামীর মৃত্যু হয় বা অন্যভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক ভঙ্গ হয়ে যায়; অথবা,
b) যদি স্বামী সালিসি পরিষদের পূর্বানুমতি ব্যতীত বা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে পরবর্তী বিবাহ করেন। (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ধারা- ৬(৫)(ক)) এ অধ্যাদেশের ১০ ধারায় বলা হয়েছে কাবিননামায় বা বিবাহের চুক্তিতে দেনমোহর তাৎক্ষণিক নাকি বিলম্বিত এমন কিছু উল্লেখ না থাকলে ধরে নিতে হবে তা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। অর্থাৎ স্ত্রী তলব করা মাত্রই শোধ করতে হবে।

বাংলাদেশী মুসলিমদের অধিকাংশ বিবাহে বিলম্বিত দেনমোহর ধার্য করা হয়ে থাকে। তালাকের সাথে Deferred বা বিলম্বিত দেনমোহরের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী স্বামী কোন কারণ ছাড়াই ইচ্ছানুযায়ী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী কোন অবস্থাতেই নিজে নিজে তালাক দিতে পারেন না। তিনি স্বামীর কাছে তালাক চাইতে পারেন বা স্বামীর ত্রুটির সুনির্দিষ্ট ৯-১০ টি কারণসহ বিচারকের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন। কারণগুলো হল-
১) স্বামীর অন্তত ৪ বছর ধরে নিঁখোজ থাকা,
২) ২ বছর ধরে ভরণপোষণ না দিতে পারা,
৩) স্ত্রীর পূর্বানুমতি ব্যতীত স্বামীর অন্য বিবাহ করা,
৪) অন্তত ৭ বছর কারাদণ্ডভোগ,
৫) পুরুষত্বহীনতা,
৬) অন্তত ২ বছর যাবৎ স্বামীর মানসিক রোগ বা কুষ্ঠ রোগ বা মারাত্মক যৌন রোগে ভুগা,
৭) ১৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তাহাকে তাহার পিতা বা অন্য কোন অভিভাক বিবাহ দিয়াছেন এবং ১৯ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি উক্ত বিবাহ নাকচ করিয়াছেন। তবে শর্ত থাকে যে, বিবাহ যৌন মিলন হয় নাই।
৮) স্ত্রীর সাথে স্বামীর নিষ্ঠুর আচরণ। এছাড়াও মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলিয়া স্বীকৃত অন্য কোন কারণে। (ধারা২, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯)

স্বামী যেমন স্ত্রীকে কোন কারণ ছাড়াই তালাক দিতে পারেন, স্ত্রী কখনোই এমনটা পারেন না। তবে কাবিননামার ১৮ নং কলামে বিবাহের সময় স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পন করে থাকলে অর্পিত ক্ষমতাবলে স্ত্রী নিজে নিজে তালাক দিতে পারেন। এটাকে তালাকুল তাফিউজ বলে। অন্যাথায় পারিবারিক আদালতে তালাকের আবেদন করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, স্ত্রী ডিভোর্স দিলেও স্বামী দেনমোহর প্রদানে বাধ্য। অবশ্য স্ত্রী মওকুফ করলে ভিন্ন কথা।

আমাদের সমাজে খামখেয়ালি কিছু পুরুষ আছেন। স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি দায়িত্বহীন কিছু স্বামীও রয়েছেন, যাদের চাপে রেখে সামাজিক সুবিচার করতে হয়, পারিবারিক সম্পর্কে বেঁধে রাখতে হয়। সেজন্য এমন পুরুষ ও নারীর পরিবার ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সুচিন্তিত সম্মতিতে উচ্চ দেনমোহরের চাপে বিবাহ টিকিয়ে রাখার জাস্টিফিকেশন সামান্য মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে বিবাহ টিকিয়ে রাখা বা বিচ্ছেদে লাভবান হবার জন্য বর্তমান সমাজে অধিকাংশ বিয়েতে পাত্রী পক্ষ Deferred Dower বা বিলম্বিত দেনমোহর দাবি করে থাকেন এবং পাত্রপক্ষ তাতে রাজি হন। ব্যাপারটা এমন- দেনমোহর ধার্য্য করা হল, স্ত্রী সেটা আদায় করবে না, স্বামীকে কখনো পরিশোধ করতেও হবে না। কেবলমাত্র যদি কখনো তালাক দিতে হয়, তখন পরিশোধ করতে হবে। তালাক দিতে হবে এমনটা বিয়ের সময় কোন ছেলে ভাবে কি? কাজেই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাজি হয়ে যায়।

এছাড়া কোন কোন বিয়ের সময় দেনমোহর হিসেবে কিছু গহনাগাঁটি এবং নগদ টাকায় আংশিকভাবে শোধ করে বাকিটা বিলম্বিত হিসেবে রেখে দেয়া হয়। উপরন্তু যেকোন প্রকার দেনমোহর আদালতের নির্দেশে বা স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতার ভিত্তিতে কিস্তিতে শোধ করা যেতে পারে।

আবার বিবাহের সময় “নির্ধারণ করা বা না করার” ভিত্তিতে দেনমোহর দুই প্রকার – Specified বা বিবাহের সময় নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত এবং Unspecified বা অনির্ধারিত যা পরোবর্তিতে সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং আদায় করা যায়। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামী এবং স্ত্রীর পারস্পরিক যোগ্যতা, বয়স, গুণ, রূপ-সৌন্দর্য্য, ভার্জিনিটি, পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস, পরিবারের অন্যান্য নারীর বিবাহে ধার্যকৃত দেনমোহরের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনা করা যেতে পারে।

দেনেোহর আদায়ের উপায়ঃ

সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে অর্থাৎ স্বামী স্বেচ্ছায় পরিশোধ না করলে ব্লাস্ট (BLAST), BHRF, আসক, অধিকার, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (BNWLA), BRAC ইত্যাদি NGO এর সহায়তা নিয়ে অসহায় মেয়েরা সহজেই দেনমোহর আদায় করে নিতে পারেন। তাছাড়া পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৫ অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে (Assistant Judge’s Court) ২৫ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে সরাসরি মামলা করে দেনমোহর আদায় করা যায় (ধারা ২৫)। এক্ষেত্রে উকিল নিযুক্ত করাসহ আরো কিছু খরচ হয়ে থাকে। এছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা ADR এর উপায় আছে। NGO গুলো এ ব্যাপারে মেয়েদেরকে দারুণ সহযোগীতা করে থাকে।

তাত্ত্বিক আলোচনা হল। এবার কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক-

ঘটনা-১ঃ চুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার একটা বেসরকারি চাকরিতে জয়েন করলেন। কিছুদিন পর ১৫ লক্ষ টাকা “বিলম্বিত দেনমোহর” ধার্য করে এক সুন্দরী মেয়েকে বিবাহ করলেন। বিয়ের ২ সপ্তাহ পর স্ত্রী মায়ের বাসায় বেড়াতে গেল। সেখানে যাবার পর মেয়ে পক্ষ স্বামীকে তালাক দিতে বললেন অন্যাথায় নারী নির্যাতনের মামলা করবেন বলে হুমকি দিলেন। তালাক চাইবার কারণ মেয়ের মা তার পছন্দের পাত্রের সাথে মেয়েকে বিবাহ দিতে চান এবং এ পর্যায়ে মেয়েটি মায়ের কথায় রাজি। ফ্রেসার একজন ইঞ্জিনিয়ার ১৫ লক্ষ টাকা কই পাবেন? ধার-দেনা করে, লোন তুলে নিঃস্ব হয়ে মাত্র ২ সপ্তাহের দাম্পত্য জীবন শেষে দুই মাসের মাথায় স্ত্রীকে ১৫ লক্ষ টাকা শোধ পূর্বক তালাক দিতে বাধ্য হলেন। উনি আমার সাথে কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন। আইনের প্রতি তার তিক্ত অনুভূতি জানিয়েছেন ।

ভেতরের ঘটনা যাইহোক, আন্ডার ৩০ বয়সী ফ্রেসার চাকরিজীবী ছেলের ১৫ লাখ টাকা ম্যানেজ করতে গিয়ে এই যে ঋণে জর্জরিত হতে হল, এই ক্ষত উনি কত বছরে পূরণ করবেন? আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত হয়ে এখন তার পরোবর্তিতে বিবাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। ২ সপ্তাহের দাম্পত্য জীবনে মেয়েটির ইনকাম ১৫ লাখ টাকা (?) এছাড়াও বিয়ের খরচের একটা উচ্চ একাউন্ট আছে। ভদ্রলোক আমাকে জোর দিয়ে বলেছিলেন উনি কোন নির্যাতন করেন নি, উনার কোন দোষ ছিল না।

ঘটনা-২ঃ কলেজ পড়ুয়া এক ছেলে সহপাঠীর প্রেমে হাবুডুবু খেল। এদিকে মেয়ের পরিবার মেয়ের অন্যত্র বিয়ে ঠিক করল। মেয়ে তো আবেগে ছেলেকে বলে দিল, এক জীবনে সে শুধু তাকেই চায়। তাকে না পেলে আত্মহত্যা করবে। ছেলেটাও মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। অনেক ভালবাসে যে! সুতরাং তারা পালালো। এদিকে মানসম্মানের ভয়ে দু পরিবার তাদের মেনে নিল। মেয়ের পরিবারের শর্তে বিবাহ হল, দেনমোহর ২০ লাখ। ছেলের পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত। এখন ছেলেটা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। আর মেয়েটা ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে এলাকার একটা সরকারি কলেজে অনার্স ভর্তি হয়ে বাবার বাড়িতে থাকতে লাগলো। ছেলেটা এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফেসবুকের যুগে মেয়েটা ওদিকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন চাকরিজীবী ছেলেদের সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখতে শুরু করল৷ মেয়েটার এখন আর এই বেকার স্বামীকে ভাল লাগছে না।

এ পর্যায়ে তার বোধোদয় (!) হল – ছাত্র স্বামী কবে পড়াশোনা শেষ করবে, আর কবেই’বা চাকরি পাবে, আবার কী চাকরি পাবে তাও অনিশ্চিত। এইসব বলে ছেলেটাকে কষ্ট দিতে লাগলো। ভার্সিটির ছুটিতে ছেলেটা বাসায় গেল। স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দেবে। রুমে ঢুকলো। স্ত্রীর মোবাইলে মুভি চলছে, সাথে ডেটা অন, স্ত্রী ওয়াশরুমে গেছে। মোবাইলে মেসেজ আসছে, শব্দ হচ্ছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছেলেটার অজ্ঞান হবার দশা। অন্য পুরুষকে সে নিজের নগ্ন ছবি সেন্ড করেছে, সেক্স চ্যাটিং করেছে, এমনকি অসংখ্যবার শারীরীক সম্পর্কও করেছে। এ অবস্থায় এমন স্ত্রীকে মেনে নেয়া যেকোনো ছেলের পক্ষে কঠিন ব্যাপার। কিছুতেই সে স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছে না। তার কথা মনে আসলেই ঘৃণা এবং আফসোসে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিত্রাণের উপায় হল তালাক দেয়া। কিন্তু বিধিবাম দেনমোহর ২০ লাখ!!!!

মেয়ে বলছে, দাও দাও তালাক দাও। কত বড় মুরোদ তোমার দেখি। “২০ লাখ টাকা দেনমোহর শোধ করে তালাক দাও, নইলে আমাকে নিয়ে যাও, নইলে নারী নির্যাতনের মামলা খাও।”- মেয়ের এবং তার পরিবারের অভিব্যক্তি। ২০ লাখ টাকা ম্যানেজ করা ভার্সিটিতে পড়া একটা সাধারণ ছাত্রের পক্ষে সম্ভব? এদিকে ধার্যকৃত দেনমোহরের পরিমাণ কমানোর এখতিয়ার স্ত্রী ভিন্ন আর কারোর নেই। ছেলেটাও অপারগ। দেনমোহর শোধ করতে পারবে না। আবার স্ত্রীকেও মেনে নিতে পারবে না। কাজেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ থাকে আত্মহত্যা??? ছেলেটা এখন মাঝেমাঝে এমন উপায় ভেবে বসছে। ধর্মমতে সেটাও মহাপাপ, আবার নিজের জীবনের মূল্য আছে, বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে। ছেলেটা এখন জীবন্ত লাশ হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

ঘটনাঃ৩
বাবা-মা জোর করে তাদের পছন্দের পাত্রের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দেনমোহর ৮ লাখ টাকা। কয়েক মাস পর মেয়েটা স্বামীকে ডিভোর্স দিল। অজুহাত তার BF এই স্বামীর থেকে থেকে হাজার গুণ ভাল ছিল। এই স্বামীকে পেয়ে উনার প্রত্যাশা মেলেনি। এই স্বামীকেও অহেতুক এত বড় আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হল। দুশ্চরিত্র হওয়া বা আচরণে অতীষ্ঠ হয়ে, কিংবা স্ত্রীর খেয়ালিপনার তালাকে উচ্চ দেনমোহর শোধ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অজস্র পুরুষ। কিংবা দেনমোহর শোধ করতে না পেরে জীবন্ত লাশ হয়ে তার সাথে সংসার করা লাগছে। এমনকি স্ত্রীর কথা না শুনলে নারী নির্যাতনের মামলায় ভুগা লাগছে।

আপনাদের ডাক্তার আকাশের কথা মনে আছে? উনি মেডিকেলের শিক্ষক ছিলেন। উনার স্ত্রী পরোকিয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন, মোবাইলে স্ত্রী এবং তার পরোকিয়া প্রেমিকের অশ্লীল আলাপন এবং অন্যান্য প্রমাণ দেখে উনি শরীরে বিষ ইনজেক্ট করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কারণ জানিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। অথচ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিল। দেনমোহর ছিল উচ্চ মানের(?) বিবাহে অনেক মেয়ের বক্তব্য থাকে এমন,”আমি এ টাকা কখনোই নেব না। তোমার দেয়া লাগবে নাকি! যাস্ট আমার প্রেস্টিজ বাড়বে, সবাইকে বলতে পারব। ইত্যাদি।” ছেলেটাও সরলভাবে চিন্তা করেন ছাড়ার জন্য তো বিয়ে করছেন না। কাগজে যেকোন একাউন্ট লিখে রাখলে সমস্যা কী!

সমাধানঃ
আমি ছোট মানুষ। পরামর্শ দেবার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমার চিন্তাভাবনা শেয়ার করছি মাত্র। এগুলোকে পরামর্শ হিসেবে না নেবার অনুরোধ রইল। আইনী পরামর্শ নেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই অভিজ্ঞ কোন বিজ্ঞ আইনজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন। আমার মতে একজন পুরুষের ৩ থেকে ৬ মাসের স্বাভাবিক ইনকামের সমপরিমাণ দেনমোহর ধার্য করা উচিৎ। ৩০-৩২ বছরের জীবিকার জীবনে ঊর্ধ্বে গেলেও ১ বছরের ইনকাম দেয়া যেতে পারে। অথবা নগদে যা সাধ্যে কুলায়, তাই দেয়া উচিৎ।

প্রথমত, আবেগে পড়ে বা ভাব নেবার জন্য বা অতিরিক্ত ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করা উচিৎ হবে না।

দ্বিতীয়ত, কোন কারণে উচ্চ দেনমোহর ধার্য হয়ে গেলে তালাকের সময় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আত্মীয় স্বজনের চাপে একটা যৌক্তিক সমঝোতায় পৌছানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আদালত দেনমোহর কমানোর ক্ষমতা রাখে না। পারিবারিক বা সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে যদি কিছু পারেন, করেন। অবশ্য দেনমোহরের পরিমাণ বেশি হলে তালাকের সময় অনেক ক্ষেত্রে আদালতে ডিফেন্স দেয়া হয় এভাবে মিথ্যা বলে, “স্ত্রী বা তার পরিবার জালিয়াতি করে বা প্রতারণা করে এমাউন্ট বেশি করেছে। বিয়ের সময় মুখে কম বলেছিল, লেখার সময় বাড়িয়েছে। ইত্যাদি।” এগুলো প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার।

তৃতীয়ত, বিয়ের সময় আবেগে না ভেসে “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” কোন সম্পর্ক ধ্রুব নয়। আজ যে প্রিয়তমা, কাল সে কাল নাগিনী হতেই পারে। আবার প্রিয়তম যে অপ্রিয়তম হবে না, সে নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারে না। জীবনটা সস্তা নয়, নয় অন্যের হাতের খেলনা। এই বিষয়টা মাথায় রেখে তবেই বিয়ে করা উচিৎ। বিবাহ হোক সুখের জন্য, অসুখী বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন সার্থকতা নেই। বিবাহ এবং ডিভোর্স উভয়ই অত্যন্ত সহজ হোক। কারোর সাথে সুখী থাকলে সে তো তাকে ডিভোর্স দেবে না, তাইনা?

পরকিয়ার ক্ষেত্রে করণীয়-

স্ত্রী যার সাথে পরোকিয়া অর্থাৎ শারীরীক সম্পর্ক করেছে, তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী মামলা করা যেতে পারে। তাতে তার সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে, সাথে অর্থদণ্ডও হতে পারে। এই মামলার মাধ্যমে স্ত্রীর চারিত্রিক স্খলনের শক্তপোক্ত প্রমাণ জানাজানি হবে। তখন পরিবার ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সালিশ করলে উচ্চ দেনমোহর সে চাইবে কোন মুখে? অথবা পরোকিয়ার মামলায় লোক জানাজানি হবার আশঙ্কায় সে আপোসে আপনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হতে পারে। মানসিক চাপ সৃষ্টি আর কী।

এবার অন্যমাত্রিক এক পর্যালোচনায়ওয়া যাক-দেনমোহর কালচারের আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতার জন্য। পুরুষের ইনকামের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া তখন নারীদের জীবন ধারণ সহজ হত না। উপরন্তু মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রপার্টি পান। সেই পরিস্থিতিতে নারীদের প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ দেনমোহরের প্রচলন হয়। এখন শিক্ষিত নারীরা সহজেই ইনকাম করতে পারছে। যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সমতা চাওয়া হচ্ছে, তখন এইরকম উচ্চ দেনমোহর চেয়ে নারীরা কেন আমার ভাইদের জীবনে অহেতুক চাপ সৃষ্টি করছেন?

ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। মনে করেন, ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন পাওয়া পাত্র এবং একই গ্রেডে বেতন পাওয়া পাত্রীর বিবাহ হল। দুজনেরই ইনকাম সমান। এখন স্বামী স্ত্রীকে দেনমোহর দেবে কেন? নারী কি এখানে পুরুষের ভোগ্য পণ্য? এক্ষেত্রে স্ত্রীকে স্বামীর ইনকামের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না। উল্টো ভরণপোষণ ও দেনমোহরের নামে পুরুষটির উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যারা নারী-পুরুষের সমতা চান, তাদের বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ। আর যারা মনে করেন, নারীদের ইনকাম করা উচিৎ না, গৃহিনী হয়ে থাকা উচিৎ, সেক্ষত্রে দেনমোহর দেয়া যৌক্তিক। তবে তার পরিমাণ যেন কসাইয়ের ছুরির মত না হয়। হাদিসেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা আছে যেন সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করা না হয়। উপরন্তু, অস্বাভাবিক দেনমোহর ধার্য করা হয়ে থাকলে কোন পক্ষের আবেদনক্রমে সেটা পুনঃনির্ধারনের ক্ষমতা বিচারকের হাতে ন্যস্ত করার জন্য সময়োপযোগী বাস্তবধর্মী আইনী বিধান করা উচিৎ।

পরিশেষে কামনা করি, জীবন হোক সুন্দর। নারী-পুরুষ কেউ কারোর খেলনা না হোক। না হোক ভোগ্য পণ্য। একইসাথে পতিতা হিসেবে অর্থের বিনিময়ে নারীকে ভোগ্য পণ্য গণ্য করার প্রবণতাও দূর হোক। শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতির সুযোগের সমতার যুগে নারী আত্ম পরিচয়ে বলীয়ান হোক। কেউ কারোর উপর নির্ভরশীল না হোক। জীবনগুলো সহজ হোক।

লেখকঃ – মতিউর রহমান, LL.B (2015-16 session), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj