এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
খুলনায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অপরাধে স্থানীয় ট্রাইব্যুনাল আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদÐ, সঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদÐাদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামি হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আসামির সাজা বহাল রেখে আবেদনটি খারিজ করে দেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, ধর্ষণ মামলায় মেডিক্যাল রিপোর্ট মুখ্য নয়, ভুক্তভোগীর মৌখিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার ভিত্তিতে আসামিকে সাজা প্রদান করা যেতে পারে।
ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করানোর বিষয় তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল ঘটনা ঘটে। আর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন ওই বছরের ১৭ মে। অর্থাৎ ৩২ দিন পর। যদি ভিকটিমকে ওইদিনই (যেদিন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেয়) ডাক্তারি পরীক্ষা করাও হতো, তবুও দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা করার কারণে ধর্ষণের কোনো আলামত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না করার কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের মামলা অপ্রমাণিত বলে গণ্য হবে না। সেইসাথে ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলেও তা মিথ্যা নয় বলেও রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ধর্ষণ আইনের নতুন সংযোজনঃ
নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী ৩২এ সংযোজন করা হয়েছে, ভিকটিমের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হবে। এ পরিবর্তন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং গত কয়েক বছরে ধর্ষণের আইন পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
যদিও ডিএনএ পরীক্ষা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে ঘটে যাওয়া সব অপরাধের ক্ষেত্রেই করতে হবে বলা হয়েছে। ধারাটিতে শব্দের প্রয়োগ যেভাবে রয়েছে, তাতে যেকোনো অপরাধের তদন্তেই পুলিশকে অপরাধের শিকার এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়েরই ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে, এমনটাই বোঝানো হয়েছে। যদিও ২০১৪ সালে ‘ডিএনএ আইন’ও প্রণীত হয়েছে, যেখানে ডিএনএ-সংক্রান্ত প্রমাণ আদালতে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ধর্ষণের মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায় না, কেননা মামলা হয়তো করা হয় অপরাধ ঘটার অনেক পরে বা আলামতগুলো হয়তো জানার ঘাটতির কারণে ভিকটিম নষ্ট করে ফেলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের সময় অপরাধী নিজেও ডিএনএ নমুনাগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারে বা আলামত নষ্ট করার জন্য ভিকটিমকে বাধ্য করতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধর্ষণের অনেক মামলাতেই বিচার্য বিষয়য হয় যৌনসঙ্গমের ক্ষেত্রে অভিযোগকারী নারীর সম্মতি ছিল কি না, সেই প্রশ্নটি। যৌনসঙ্গম আদৌ হয়েছে কি না, তা প্রমাণ করতে ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষা দিয়ে সম্মতি ছিল কি না তা কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সম্মতি যে ছিল না বা ধর্ষণ যে হয়েছে, তা প্রমাণে এখনকার প্রচলিত পদ্ধতিতেই নারীকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। তার ওপর যদি যুক্ত হয় ডিএনএ প্রমাণ উপস্থাপনের ব্যর্থতা, তাহলে অভিযোগকারীর অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করতে আরও বেগ পেতে হবে, এমন আশঙ্কাই স্বাভাবিক।
ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ একটি জটিল বিষয়ও বটে। সঠিকভাবে না করা গেলে ডিএনএ নমুনা দূষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাতে ফলাফল সঠিক আসবে না। সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী ব্যক্তির দক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশংকার ব্যাপার হলো এই যে, অনিয়ম হোক আর অদক্ষতাই হোক, ডিএনএ পরীক্ষার ফল যদি নির্ভুল না আসে, তাহলে তা যেমন একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে, তেমনই একজন অপরাধীকেও সহজেই সাজামুক্ত করতে পারে।
আরও একটি বিষয় হলো এই যে, ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করতেই হবে, তাতে ভিকটিম কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। ডিএনএ-সংক্রান্ত তথ্যের ওপর যেকোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে এবং এ কারণেই ২০১৪ সালের ডিএনএ আইনে ভিকটিম ও অভিযুক্ত ব্যক্তি দুজনেরই সম্মতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্মতি না থাকলে আদালতের কাছ থেকে অনুমতি আনলেও তাকে সম্মতি ধরা হবে না। ভিকটিম যখন জানবেন এ তথ্য বিবাদীপক্ষের কাছে যেতে পারে, উন্মুক্ত আদালতেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ কর্তৃক একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলাকে ধর্ষন করা সম্ভব নয়। উপরন্ত কোন স্ত্রীলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন সংগম করা হলে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীলোকের দেহের বা শরীরের কোন না কোন অংশে বা জায়গায় জখম বা আঘাতের চিহ্ন থাকবে এবং এটা মেডিক্যাল রিপোর্ট দ্বারা সমর্থিত হবে। কিন্তু ধর্ষণের মামলায় যখন ভিকটিমের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নাই এবং ভিকটিমের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকলে তাকে ধর্ষণ বলা যাবে না। (১৮ ডিএলআর ৯১)
মোদির মেডিক্যাল জুরিসপ্রæডেন্স এ স্পষ্ট বলা আছে যে, ধর্ষিতা মেয়ে যদি বয়স্কা হয় তবে তাহার লিখিত অনুমতি ছাড়া ডাক্তারী পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতাকে পরীক্ষা করিতে হইলে নার্স অথবা নিরপেক্ষ লোক সামনে থাকা উচিত। ধর্ষিতার লিখিত অনুমতি ছাড়া তাহাকে পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতা যদি নাবালিকা হয় তবে তাহার অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতার অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা করা হইলে ইহা তাহার উপর শারীরিক আক্রমণ বলিয়া গণ্য হইবে। ধর্ষিতাকে পরীক্ষার সময় ডাক্তার তাহার শরীরের কাপড় চোপড় স্বেচ্ছায় খুলিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিতে হইবে। পাশাপাশি ধর্ষিতার মেডিক্যাল রিপোর্ট না থাকলে প্রসিকিউশন কেস সন্দেহজনক হবে (৯ বিএলডি, ৩১৪)।
আব্দুল কাদের বনাম রাষ্ট্র মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, ভিকটিমকে মেডিকেল অফিসার কর্তৃক পরীক্ষা করা হয়নি। ভিকটিম একাধিকবার আসামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় ইচ্ছাকৃত অংশীদার হিসেবে যৌন সহবাস করেছে। মামলাটি বিলম্বে হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হইয়াছে। সেকারণ উক্ত শাস্তি ও দন্ড রহিত করা হলো। (১২ এমএলআর, পৃষ্ঠা-৪০৯)
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রæতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ঊসধরষ:ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
ধর্ষণ মামলা প্রমাণে মেডিক্যাল রিপোর্টের গুরুত্ব, আইনের নতুন সংযোজন ও বাস্তবতা!
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
খুলনায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অপরাধে স্থানীয় ট্রাইব্যুনাল আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদÐ, সঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদÐাদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামি হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আসামির সাজা বহাল রেখে আবেদনটি খারিজ করে দেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, ধর্ষণ মামলায় মেডিক্যাল রিপোর্ট মুখ্য নয়, ভুক্তভোগীর মৌখিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার ভিত্তিতে আসামিকে সাজা প্রদান করা যেতে পারে।
ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করানোর বিষয় তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল ঘটনা ঘটে। আর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন ওই বছরের ১৭ মে। অর্থাৎ ৩২ দিন পর। যদি ভিকটিমকে ওইদিনই (যেদিন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেয়) ডাক্তারি পরীক্ষা করাও হতো, তবুও দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা করার কারণে ধর্ষণের কোনো আলামত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না করার কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের মামলা অপ্রমাণিত বলে গণ্য হবে না। সেইসাথে ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলেও তা মিথ্যা নয় বলেও রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ধর্ষণ আইনের নতুন সংযোজনঃ
নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী ৩২এ সংযোজন করা হয়েছে, ভিকটিমের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হবে। এ পরিবর্তন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং গত কয়েক বছরে ধর্ষণের আইন পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
যদিও ডিএনএ পরীক্ষা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে ঘটে যাওয়া সব অপরাধের ক্ষেত্রেই করতে হবে বলা হয়েছে। ধারাটিতে শব্দের প্রয়োগ যেভাবে রয়েছে, তাতে যেকোনো অপরাধের তদন্তেই পুলিশকে অপরাধের শিকার এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়েরই ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে, এমনটাই বোঝানো হয়েছে। যদিও ২০১৪ সালে ‘ডিএনএ আইন’ও প্রণীত হয়েছে, যেখানে ডিএনএ-সংক্রান্ত প্রমাণ আদালতে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ধর্ষণের মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায় না, কেননা মামলা হয়তো করা হয় অপরাধ ঘটার অনেক পরে বা আলামতগুলো হয়তো জানার ঘাটতির কারণে ভিকটিম নষ্ট করে ফেলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের সময় অপরাধী নিজেও ডিএনএ নমুনাগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারে বা আলামত নষ্ট করার জন্য ভিকটিমকে বাধ্য করতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধর্ষণের অনেক মামলাতেই বিচার্য বিষয়য হয় যৌনসঙ্গমের ক্ষেত্রে অভিযোগকারী নারীর সম্মতি ছিল কি না, সেই প্রশ্নটি। যৌনসঙ্গম আদৌ হয়েছে কি না, তা প্রমাণ করতে ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষা দিয়ে সম্মতি ছিল কি না তা কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সম্মতি যে ছিল না বা ধর্ষণ যে হয়েছে, তা প্রমাণে এখনকার প্রচলিত পদ্ধতিতেই নারীকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। তার ওপর যদি যুক্ত হয় ডিএনএ প্রমাণ উপস্থাপনের ব্যর্থতা, তাহলে অভিযোগকারীর অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করতে আরও বেগ পেতে হবে, এমন আশঙ্কাই স্বাভাবিক।
ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ একটি জটিল বিষয়ও বটে। সঠিকভাবে না করা গেলে ডিএনএ নমুনা দূষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাতে ফলাফল সঠিক আসবে না। সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী ব্যক্তির দক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশংকার ব্যাপার হলো এই যে, অনিয়ম হোক আর অদক্ষতাই হোক, ডিএনএ পরীক্ষার ফল যদি নির্ভুল না আসে, তাহলে তা যেমন একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে, তেমনই একজন অপরাধীকেও সহজেই সাজামুক্ত করতে পারে।
আরও একটি বিষয় হলো এই যে, ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করতেই হবে, তাতে ভিকটিম কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। ডিএনএ-সংক্রান্ত তথ্যের ওপর যেকোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে এবং এ কারণেই ২০১৪ সালের ডিএনএ আইনে ভিকটিম ও অভিযুক্ত ব্যক্তি দুজনেরই সম্মতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্মতি না থাকলে আদালতের কাছ থেকে অনুমতি আনলেও তাকে সম্মতি ধরা হবে না। ভিকটিম যখন জানবেন এ তথ্য বিবাদীপক্ষের কাছে যেতে পারে, উন্মুক্ত আদালতেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ কর্তৃক একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলাকে ধর্ষন করা সম্ভব নয়। উপরন্ত কোন স্ত্রীলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন সংগম করা হলে, সেক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীলোকের দেহের বা শরীরের কোন না কোন অংশে বা জায়গায় জখম বা আঘাতের চিহ্ন থাকবে এবং এটা মেডিক্যাল রিপোর্ট দ্বারা সমর্থিত হবে। কিন্তু ধর্ষণের মামলায় যখন ভিকটিমের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নাই এবং ভিকটিমের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকলে তাকে ধর্ষণ বলা যাবে না। (১৮ ডিএলআর ৯১)
মোদির মেডিক্যাল জুরিসপ্রæডেন্স এ স্পষ্ট বলা আছে যে, ধর্ষিতা মেয়ে যদি বয়স্কা হয় তবে তাহার লিখিত অনুমতি ছাড়া ডাক্তারী পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতাকে পরীক্ষা করিতে হইলে নার্স অথবা নিরপেক্ষ লোক সামনে থাকা উচিত। ধর্ষিতার লিখিত অনুমতি ছাড়া তাহাকে পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতা যদি নাবালিকা হয় তবে তাহার অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা করা যাইবে না। ধর্ষিতার অনুমতি ছাড়া পরীক্ষা করা হইলে ইহা তাহার উপর শারীরিক আক্রমণ বলিয়া গণ্য হইবে। ধর্ষিতাকে পরীক্ষার সময় ডাক্তার তাহার শরীরের কাপড় চোপড় স্বেচ্ছায় খুলিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিতে হইবে। পাশাপাশি ধর্ষিতার মেডিক্যাল রিপোর্ট না থাকলে প্রসিকিউশন কেস সন্দেহজনক হবে (৯ বিএলডি, ৩১৪)।
আব্দুল কাদের বনাম রাষ্ট্র মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, ভিকটিমকে মেডিকেল অফিসার কর্তৃক পরীক্ষা করা হয়নি। ভিকটিম একাধিকবার আসামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় ইচ্ছাকৃত অংশীদার হিসেবে যৌন সহবাস করেছে। মামলাটি বিলম্বে হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হইয়াছে। সেকারণ উক্ত শাস্তি ও দন্ড রহিত করা হলো। (১২ এমএলআর, পৃষ্ঠা-৪০৯)
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রæতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮