মোঃ শামসুদ্দোহা
করোনা উত্তর পৃথিবী কেমন হবে এই নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। কেউ তুলে ধরছেন পরিস্থিতির পরবর্তী অর্থনীতি কেমন হবে। কেউ আবার তুলে ধরছেন করো না পরিস্থিতি পরবর্তী সামাজিক অবস্থা কেমন হবে। কেউ কেউ তুলে ধরছেন করোনা পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে।করোনা পরিস্থিতির পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখে যাচ্ছেন অনেকেই। আমি যেহেতু শিক্ষার্থী তাই আমার মনে হল করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ সমূহ কি হতে পারে? তা নিয়ে আমার কিছু বলা উচিত। আমরা সবাই অবগত আছি,সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্য ৮০ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য।
এই শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করে টিউশনি করে কেউ কেউ আবার পার্ট টাইম জব করে আবার কেউ কেউ নিজে ছোট পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা এর আশে-পাশে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে। অনেক শিক্ষার্থী তার এই কর্ম-লব্ধ আয়ের একাংশ দিয়ে তার অসহয় পরিবারকে সাহায্য করে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেকে টিউশনি হারাবে, অনেক শিক্ষার্থী তার পার্ট টাইম জব হারাবে এবং অনেক শিক্ষার্থী তার পরিবার থেকে আগে যতোটুকু সাপোর্ট পেত হয়ত সে সেটা আর পাবে না। সুতরাং এই পরিস্থিতি পূর্বের মত ধারাবাহিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আসলে একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার । সুতরাং, সমাজের সকলের প্রধান কর্তব্য হল এই করোনা উত্তর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সামনে যে অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ তা মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন জেলা শহরে অবস্থিত, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা যাদেরকে টিউশনি করান তদের অধিকাংশ পরিবারের পিতা বা সদস্য ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের ব্যাবসায়ী। আর এই ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের সারা বছরে যা বিক্রি হয় তার সমপরিমান বা ক্ষেত্র বিশেষে এর থেকে বেশি বিক্রি হয় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। ইতিমধ্য পহেলা বৈশাখের মৌসুমটা ব্যাবসায়ীদের জন্য ছিল স্মরণ কালের সবথেকে খারাপ মৌসুম । সামনে ঈদের মৌসুম ,যদিও সীমিত পরিসরে দোকান-পাট খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু এই ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ কতটুকু টাকা খরচ করবেন সেটা একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার এবং পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা বলা যায় করোনা পরবর্তী সময়ে অনেকেই তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক ব্যাবস্থা গ্রহন করবে। এতে অনেকে তার বাচ্চার টিউশনি বাদ দিবে , অনেকেই তার কর্মচারী ছাটাই করবেন । এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সব শিক্ষার্থীদের উপর যারা তাদের ব্যয় নির্বাহ করে টিউশনি করিয়ে বা পার্ট টাইম জব করে ।
এই সকল শিক্ষার্থীরা যে করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে অদৃশ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। হয়ত অনেক শিক্ষার্থী তার উচ্চশিক্ষার অধ্যয়ন বাদ দিতে বাধ্য হবে , অনেকের ক্ষেত্রে অধ্যয়ন চালু রাখা দুস্কর হয়ে উঠবে। এই চিত্রটি শুধুমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমনটা নয় এই চিত্রটা আসলে পাবলিক এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য কেননা প্রাইভেট বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যায় নির্বাহ করে শহরে টিউশনি করে অথবা পার্টটাইম জব করে অথবা বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে। সুতরাং মোটামুটি এটুকু নিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছে কিছু অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ। আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল এই শিক্ষার্থীদের টিকিয়ে রাখা। আর যদি এই শিক্ষার্থীদের কে টিকিয়ে রাখা না যায়, তাহলে রাষ্ট্রের এবং সমাজের এবং এই শিক্ষার্থীদের ১৩ থেকে ১৫ বছরের পরিশ্রম আসলে বৃথা যাবে। এই সময়ে এই সকল শিক্ষার্থীদের পাশে এগিয়ে না আসা হবে তাদের লালিত সপ্ন গুলোকে গলাটিপে হত্যা করার শামিল।
রাষ্ট্র কি করতে পারে?
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের কাছে আসলে যথেষ্ট পরিমাণ কৃতজ্ঞ। কেননা প্রতিবছর বাংলাদেশের সরকার এই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের শিক্ষা খাতে ,অবকাঠামো খাতে এবং আরো বিভিন্ন খাতে বিশাল অংকের বাজেট দিয়ে থাকে। করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা সরকারের কাছ থেকে একটি বিশেষ বাজেট প্রত্যাশা করতেছি যে বাজেটে অবকাঠামোগত উন্নতি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের কে টিকে থাকার জন্য তাদের পড়ালেখা চালিয়ে রাখার জন্য তাদের হাতে একটি বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও সরকার অন্য একটি কাজ করতে পারে সেটা হল শিক্ষার্থীদের জন্য অল্প সুদে একটি বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া। এই ঋণ পরিশোধে তিন থেকে সাত বছরের সময় দেয়া যেতে পারে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি করতে পারে?
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকল্যাণ তহবিল নামে একটি তহবিল আছে এছাড়াও প্রত্যেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক বছর ভর্তি কালীন মৌসুমে কয়েক কোটি টাকা আয় করে থাকে। এখন সময় এসেছে এই টাকাগুলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ব্যয় করার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত এই টাকাগুলো দিয়ে তাদেরকে অনুদান দেয়া । সকল শিক্ষার্থীদের অন্তত দুই সেমিস্টার এর ভর্তি ফি মওকুফ করা সহ এক বছরের জন্য ফরম ফিলাপ ফি সহ সকল ধরণের ফি স্থগিত করা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি করতে পারে?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তরফ থেকে জানানো হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে এক বছর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি রয়েছে। সুতরাং, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত অন্তত তাদের শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টারের সেমিস্টার ফি মওকুফ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সহযোগিতা করা।
সমাজ কী করতে পারে?
আমরা সকলে অবগত আছি যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন এলাকার বাসা মালিকগণ ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশস পর্যন্ত বাসাভাড়া মোওকুফ করে একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এটা আসলে শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধরনের একটি উপকার। এছাড়াও সমাজের অন্য সকল ব্যক্তিবর্গ যেমন সমাজকর্মী , রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ , শিক্ষক, আইনজীবী সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ইতিমধ্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এই সকল শিক্ষার্থীদের পাশে এগিয়ে আসলে তাদের সামনে অপেক্ষমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সহজ হবে । সকলের সহযোগিতায় এই সকল শিক্ষার্থীদের হাত ধরে আগামী দিনের নতুন সূর্য বিশ্বকে আলোকিত করবে।
লেখকঃ মোঃ শামসুদ্দোহা, লেখক ও কলামিস্ট, ইমেইলঃ mdshamsuddoha.law@gamil.com
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত এবং এজন্য তিনি নিজে দায় বহন করিবেন।