এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে আছেন। দেশে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ খবর কিংবা ভরণপোষণ দেন না। উল্টো করে স্ত্রীর উপর নানারকম অপবাদ লেপন করছে। এমতাবস্থায় স্ত্রী বিদেশে থাকা ওই স্বামীর সাথে ঘর সংসার করতে চান না, তালাক দিতে চান। হ্যাঁ, স্ত্রী তালাক দিতে পারেন এবং অন্যত্র বিয়েও করতে পারবেন।
বিয়ের কাবিননামা বা নিকাহনামার ১৮ নং কলামে লেখা আছে যে স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেছে কি-না? এ প্রশ্নের উত্তরে যদি হ্যাঁ লেখা থাকে তাহলে স্ত্রীর পক্ষে তালাক প্রদানে কোন সমস্যা নেই। সাধারণত নিরানব্বই ভাগ কাবিননামার এ ঘরটিতে হ্যাঁ শব্দটি লেখা থাকে। সেকারণ বিয়ের সময় নিকাহনামার ১৮ নং ঘরটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পূরণ করা উচিত। অনেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে জানেনা এবং ঘরটি শূন্য থাকে। বিয়ে পড়ানোর সময় কাজীদের অবশ্যই দু’পক্ষকে এই ১৮ নং কলাম বা ঘরটি সম্পর্কে বিশেষভাবে জানানো উচিত। এই হ্যাঁ শব্দের বলে স্ত্রী তার বিদেশে থাকা স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এ তালাককে তালাক-ই-তৌফিজ বলে।
কাবিননামার এ ক্ষমতা বলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব পালনে অপারগতার কারণে স্ত্রী নিজ নফসের প্রতি তালাকের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন এ বিষয়ে ৯ ডিএলআর ৪৫৫ পৃষ্টায় একটি কেইস ষ্টাডিও উল্লেখ রয়েছে। এক্ষেত্রে যেহেতু স্ত্রী তালাক দিচ্ছেন তাই তালাক সংক্রান্ত নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে এবং এর কপি স্বামীর কাছে পাঠাতে হবে। এখানে জানিয়ে রাখি যে, তালাক আপনি ঘরে বসেই দিতে পারেন। এর জন্য কাজীর কাছে কিংবা কোর্ট কাচারীতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, এমনকি বিয়ের কাবিননামারও কোন দরকার নেই। স্ত্রীর দায়িত্ব তালাক ঘোষণার পর স্বামী বিদেশে যেখানে অবস্থান করছেন সেই ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে দেয়া। সেইসাথে স্বামীর দেশের ঠিকানাতেও নোটিশের একটি কপি পাঠিয়ে দিন। এমনকি আপনার স্বামীর দেশে থাকা পিতা-মাতা, ভাই বোন কিংবা যিনি অভিভাবক হিসেবে আছেন তালাকের বিষয় অবগত করতে তাকেও একটি নোটিশ পাঠাতে পারেন। আর আপনার স্বামীর এলাকার চেয়ারম্যানকে নোটিশ তো দিতেই হবে। এখানে চেয়ারম্যান বলতে আপনার স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা যদি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে হয় তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট, পৌরসভা হলে পৌরসভার মেয়র এবং সিটি কর্পোরেশন হলে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নোটিশ দিতে হবে। অনেকে তালাক দিয়ে তালাকের কপি চেয়ারম্যান কিংবা যাকে তালাক দেয়া হয় তাকে না পাঠিয়ে তিন মাস পরে পাঠালে তালাক কার্যকর হবে-এমন ভ্রান্ত ধারনা নিজের মনের মধ্যে লালন পালন করে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা এবং আপনারা এখনও ভুলের মধ্যে রয়েছেন।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তালাক দেয়ার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে। কাজেই তালাক দিয়ে তালাকের নোটিশ নিজের কাছে বা ঘরের মধ্যে রেখে দিলে তালাক হবে না। এখন জানার বিষয় হচ্ছে তালাকের নোটিশ কিভাবে লিখবেন। এর জন্য আইন নির্দিষ্ট কোনো ফরম বা বক্তব্য নির্ধারণ করেনি। নোটিশ লেখা কাজটি আপনি ঘরে বসে নিজেই লিখতে পারেন। আপনি কি কারণে তালাক দিতে চান, কথাগুলো সাদা কাগজে লিখে এটাকে তালাকের নোটিশ হিসেবে পাঠাতে পারেন। পাঠানোর কাজটি আপনি নিজেও করতে পারেন, আবার অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারেন। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগে রেজিষ্ট্রি করে এডি সহযোগে পাঠালে ভাল হয়।
চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক কার্যকর হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র দুই পক্ষের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করে থাকে। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে তালাকদাতা ও তালাকগ্রহীতাকে। আপোষ মীমাংসা হয়ে গেলে যিনি তালাক দিয়েছেন, তিনি তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক আর কার্যকর হবে না। আর মনে রাখবেন নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি কেউ অন্য কারও সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে উক্ত বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে ১৫ ডি.এল.আর পৃষ্ঠা-৯ তে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। কারণ তালাক সম্পূর্ণ কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগন আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।
আপনাকে জেনে রাখতে হবে যে, চেয়ারম্যান/মেয়র মহোদয় কর্তৃক কোন নোটিশ পাঠানো কিংবা শালিশী পরিষদ গঠন করুক বা না করুক নোটিশ পাঠানো এবং ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। এরপর আপনার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে ঘর সংসার করতে পারবেন। আইনে কোথাও বাঁধা নেই।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮