সব
facebook apsnews24.com
মহাজনী-সুদ কারবারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরী - APSNews24.Com

মহাজনী-সুদ কারবারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরী

মহাজনী-সুদ কারবারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরী

রায়হান কাওসার

মামলার কাগজ এসেছে। কোর্টে উপস্থিত হতে হবে তাহাজ মন্ডলকে। চেকের মামলা হয়েছে। ফাঁকা চেক দিয়ে নয় মাস আগে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছিল সে। এক সুদ-কারবারি তার বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকার মামলা করেছে। সুদ কারবারিরা টাকা ধার দেওয়ার আগে জামানত হিসেবে ফাঁকা চেক নিয়ে রাখে। চেক ছাড়া কোন লেন-দেন করে না। ফাঁকা চেক নেওয়ার সুবিধা হলো- ইচ্ছেমত টাকার পরিমাণ বসিয়ে মামলা করা যায় যে কোন সময়। সুদের টাকা ফেরত দিতে দেরী হলে সুদ-ব্যবসায়ীরা ফাঁকা চেকে ইচ্ছেমত টাকার অ্যামাউন্ট বসিয়ে মামলা করে দেয়।

মামলা হয়েছে শুনে বেশ বিচলিত তাহাজ মন্ডল। বিপদে পড়ে কিছু টাকা লোন নিয়ে আরও বড় বিপদ ডেকে এনেছে সে। নয়’মাস আগের কথা। সন্ধ্যা বেলা তাহাজ মন্ডলের ছেলে অনেক কান্নাকাটি করছিল। পেটে অনেক ব্যথা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারল এ্যাপেন্ডিসাইড হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। হাতে টাকা নেই। কিন্তু অপারেশন তো করতে হবে! অন্য কোথাও ম্যানেজ করতে না পেরে ত্রিশ হাজার টাকা সুদের উপর ধার নিল। গ্যারান্টি হিসেবে দিল একটা ফাঁকা চেক। কিন্তু সেই চেক দিয়ে যে এত বিপদ হবে কে জানে! টাকা দিতে দেরী হওয়ায় সুদ-ব্যবসায়ী মামলা করে দিয়েছে।

সুদ ব্যবসায়ীরা লোক বুঝে এবং বিপদ বুঝে সুদ আরোপ করে। এক লক্ষ টাকার মাসিক সুদ ছয় হাজার টাকা থেকে দশ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এক লাখ টাকার মাসিক সুদ যদি ছয় হাজার টাকা হয়, তাহলে এক লাখে বার মাসে সুদ দাঁড়ায় বাহাত্তর হাজার টাকা, আসল টাকা তো পড়েই রইল। একজন কৃষক কিংবা মধ্যবিত্তের পক্ষে কী এই পরিমাণ সুদের ভার বহন করা সম্ভব? এছাড়া আপনি যদি সপ্তাহ হিসেবে টাকা নেন, আপনাকে সপ্তাহে হাজারে ৮০-১২০ টাকা দেওয়া লাগতে পারে। মানুষ বিপদে পড়লে তারা এভাবেই সুদ আরোপ করে থাকে। সুদের এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা ততটা সহজ নয়, যত সহজে একজন ভুক্তভোগী টাকাটি গ্রহণ করে।  টাকা দিতে না পারলেই ফাঁকা চেকে অধিক টাকা বসিয়ে মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়।  

গ্রাম এলাকায় সুদের ব্যবসা হচ্ছে এখন নতুন নতুন পন্থায়। প্রয়োজন যতই মানবিক হোক না কেন, বর্তমানে কেউ কাউকে একটি টাকাও লাভ ছাড়া ধার দিতে চাইবে না। সেই আগের দিন আর নেই! এখন সকলেই লভ্যাংশ খোঁজে। সুদ কারবারিদের দেখে দেখে গ্রামের টাকাওয়ালা সুশীলরাও এখন এককালীন সুদে টাকা দিচ্ছে  লোকজনকে। এদের নিয়মটা একটু আলাদা। এরা কিছুটা মানবিক। এরা মহাজন অপেক্ষা কম চার্জ করে। এক লাখ টাকা নিলে বছরে ৩৫-৪০ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে আপনাকে। আসল টাকা আসলই থাকবে। গ্রামীণ সুশীলদের যুক্তি হলো, তারা এক লাখে বছরে নিচ্ছে ৩৫-৪০ হাজার টাকা, কিন্তু সুদ কারবারিরা তো আরও বেশি নিচ্ছে; বছরে ৭২-৯০ হাজারের মত। সুতরাং, তারা সুদ ব্যবসায়ীদের থেকে ভাল।

অভাব-অনটনের সংসার। ত্রিশ হাজার টাকার সুদ টানতে পারে নাই তাহাজ মন্ডল। ভেবেছিল ৩০ হাজার টাকার জন্য মামলা করবে না সুদ ব্যবসায়ীরা। সুদ ব্যব্যসায়ীদের উদ্দেশ্য হলো মামলার চাপে ফেলে মীমাংসায় বসানো। গ্রাম্য মীমাংসায় বসিয়ে সুদসহ আসল টাকা যতটা পারা যায় আদায় করে নেওয়া। টাকা দিতে না পারলে মামলা চলতেই থাকবে। পাশের গ্রামের আশরাফের ছেলে সহিদ মামলার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে নারায়নগঞ্জ আছে। গার্মেন্টসে কাজ করে। কিছুদিন হলো তার স্ত্রীও সেখানে চলে গেছে। মাঝে মাঝে থানার পুলিশ এসে খোঁজ করে সহিদের। না পেয়ে চলে যায়।

গরীবদের জন্য ব্যাংকে গিয়ে লোন পাওয়া অত সোজা নয়। কৃষকের নাম শুনলে অনেক ব্যাংক নড়েচড়ে বসে। ভাল ব্যবসা থাকলে, লোনের বিপরীতে জামানত দিতে পারলে তারা আপনাকে বসিয়ে চা খাওয়াবে, লোনও দিবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ী লোকজনকেই বেশি খোঁজে, গরীবদের নয়।

সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই এগিয়ে- এমনটিই শোনা যায়। সরকারি ব্যাংকগুলো তেমন কাস্টমার ফ্রেন্ডলি না। গ্রাহক লোন পেলেই কী, না পেলেই কী। দ্রুত পেলেই কী, আর দেরীতে পেলেই কী- তারা তাদের গতিতেই চলবে- এমনটিই শোনা যায়।

আবার, গ্রাম এলাকায় রয়েছে শত শত ঋণদানকারী এনজিও। এদের দুর্নামও কম নেই। বৃষ্টি-বাদল যাই হোক না কেন, মাইক্রো-ক্রেডিটের লোকগুলো কিস্তির টাকার জন্য ঋণ গ্রহিতার বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে। তাদের যুক্তি হলো, ঋণগ্রহিতা যদি কোন কিস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, সেই কিস্তির টাকা সংশ্লিষ্ট লোন অফিসারের বেতন থেকে কেটে রাখা হবে। অফিসের চাপে লোন অফিসারগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে।

চেষ্টা-তদবির করে সরকারি চাকুরী যখন একেবারেই পায় না, তবেই কেবল একজন শিক্ষিত যুবক এসব এনজিওতে লোন অফিসার হিসেবে জয়েন করে। বলা যায়, এটাই তাদের শেষ সম্বল। ফলে, চাকুরী টিকিয়ে রাখার জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লোন আদায় করার চেষ্টা করে। তারাও একরকম এনজিও মালিকদের কাছে ধরা। প্রত্যেক লোন অফিসারকেই মাসিক কিংবা বাৎসরিক একটা টারগেট দেওয়া হয়- যেটা অর্জন করা সত্যি অনেক কঠিন। ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় ঋণগ্রহিতার বাড়ির টিন পর্যন্ত খুলে আনা হয়েছে- এমন অভিযোগও শোনা গেছে একটি এলাকায়। তাই, গ্রামের অভাবী, দিনমজুর এবং খেটে-খাওয়া লোকজন এনজিওগুলোর কাছেও যেতে চায় না সহজে।

এছাড়াও রয়েছে নানা কো-অপারেটিভ সোসাইটি। বিভিন্ন এলাকায় কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে যে সকল সমিতি রয়েছে, অনেকের মূল কাজই হলো সুদের ব্যবসা করা। সাধারণ লোকজনের কোন উপকারের জন্য কোন কাজ করে না এরা। কিভাবে সম্মিলিত উদ্যোগে সুদের ব্যবসা করা যায়- সেটিই তাদের মূল লক্ষ্য।

সুদ কারবারীরা এলাকার প্রভাবশালী কিংবা দাঙ্গাবাজ হওয়ায় এদের সাথে কেউ ঝগড়া করতে যায় না। আর হাতে টাকা থাকলে অনেককেই ম্যানেজ হয়ে যায়। ফলে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিবাদ করে না কেউ। প্রতিবাদ করে আবার বিপদে না পড়ি- এই ভয়ে অনেকেই এসব বিষয়ে নাক গলান না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ এর ৫ ধারা মতে, কোন ব্যক্তি লাইসেন্স ব্যতীত অর্থায়ন ব্যবসা করতে পারবেন না, করলে, ধারা ৩০ অনুযায়ী দুই বৎসর পর্যন্ত সাজার কথা বলা হয়েছে। সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে- যথাযথ আইনী কাঠামো প্রণয়ন করে এসকল বিবেকহীন সুদ-কারবারিদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এসকল সুদখোরদের ব্যবসা হয় একটি আইনী ও প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে,  নইলে এদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। তা না হলে, দেশের নানা প্রান্তে ভুক্তভোগী সাধারণ জনতা এদের অত্যাচারে নিঃশেষ হয়ে যাবে দিনে দিনে।

বিঃ দ্রঃ তাহাজ মন্ডল ও সহিদ নাম দুটি রূপক।

লেখকঃ মোঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ইমেলঃ raihankawsardu@gmail.com

মতামত এর জন্য লেখক দায়ী থাকিবেন ।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj