সোয়েব আক্তার
জামিন পাওয়া কথাটির সাথে আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম অনেকটাই জড়িত এবং কোন ক্রিমিনাল মামলায় কেউ আটক হলে জামিন পাওয়াটাই তখন আসামীর কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। পুরো ক্রিমিনাল জাস্টিসকে কিভাবে পরিচালনা করতে হবে এর জন্য আমাদের রয়েছে দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা সিআরপিসি ১৮৯৮। যদিও কালের বিবর্তনে সৃষ্ট নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে বিশেষ আইন করা হলেও এসব বিশেষ আইনগুলোর অনেকগুলোতেই আবার সিআরপিসি কে অনুসরণ করার কথা বলা আছে।যাইহোক, সম্প্রতি বিবিসি নিউজসহ স্বনামধন্য দেশি অনেক পত্রিকায় দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়া হচ্ছে।
আমার আলোচনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, সিআরপিসির অধীনে একজন ম্যাজিস্ট্রেট জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে এসব শর্ত কতটুকু জুড়ে দিতে পারেন। প্রথমেই দেখে নেয়ার চেষ্টা করবো সিআরপিসি ১৮৯৮ জামিন নিয়ে কি বলে এবং এরপর দেখার চেষ্টা করবো এসব বিষয়ে আমাদের উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা কি।সাধারণত সিআরপিসি অধ্যায়-৩৯ জামিন নিয়ে কথা বলে, ৪৯৬ থেকে ৪৯৯ এ কয়েকটা ধারা জামিনের সাথে সরাসরি জড়িত। এছাড়াও অন্য আরও কয়েকটি ধারাতেও জামিনের অল্প কিছু বিধান রয়েছে। সে যাই হোক, জামিনের প্রধান প্রধান ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে আলোচনার প্রধান বিষয়টির উত্তর পাওয়া যাবে। সিআরপিসি অপরাধসমূহকে জামিনযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য এ ২ ভাগে ভাগ করেছে।
সিআরপিসি ধারা ৪৯৬ জামিনযোগ্য অপরাধের কথা বলে এবং এ ধারা অনুযায়ী একজন আসামী অধিকার হিসেবে(as of right) জামিন চাইতে পারে। মিয়া নুরুদ্দীন বনাম রাষ্ট্র (৬৬ ডিএলআর এডি ২৯০) এ মামলায় উচ্চ আদালত বলেছে, আসামী জামিনযোগ্য অপরাধের মামলায় অধিকার হিসেবে জামিন চাইতে পারে এবং আদালত তখন জামিন দিতে বাধ্য। তার মানে জামিনযোগ্য অপরাধের মামলায় জামিন দিবে কি দিবে না এরকম বিচক্ষণতা(discretion) দেখানোর সুযোগ নেই। এবার আসি অ-জামিনযোগ্য অপরাধের বিষয়ে, ধারা ৪৯৭ এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলে। আলোচনার সুবিধার জন্য এ ধারাকে ২টা অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে- (১) যখন জামিন না দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে, (২) অপরাধসমূহ যেগুলো এ ধারার অধীনে বিচারক চাইলে জামিন দিতে পারে।তবে এক্ষেত্রে শুধু অপরাধটি অ-জামিনযোগ্য হওয়া আর এফআইআর এর উপর ভিত্তি করে জামিন না দেয়াটাও যোক্তিক নয়- (৪৪ ডিএলআর ১৯২)।
শুধু তাই নয়, অভিযোগকৃত অপরাধটির সাজা মৃত্যুদন্ড এটার উপর ভিত্তি করে জামিন না দেয়াটাও উচিত নয় বলে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন- (৪০ ডিএলআর এডি ২৯০)। কোন মামলায় এমন পর্যাপ্ত কিছু কারণ থাকতে হবে যা আসামীর বিরূদ্ধে আনীত অপরাধটির সাথে আসামীর সংযোগ স্থাপন করে- (৪৪ ডিএলআর ১৯২)। তার মানে অপরাধটি অ-জামিনযোগ্য দেখেই যে কাউকে জামিন দেয়া যাবে না বিষয়টি এমন নয়।৪৯৭ ধারাটি অ-জামিনযোগ্য হলেও এ ধারার অধীনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারকের বিচক্ষণতা(discretion) ব্যবহার করার বিধান রয়েছে, যেমনঃ আসামী কোন নারী, ৬০ বছরের অধিক বয়স্ক কোন ব্যক্তি অথবা অসুস্থ কোন ব্যক্তি, এমন ক্ষেত্রে আদালত চাইলে জামিন দিতে পারে।জামিন মঞ্জুর করার সাথে অনেক সময় শর্ত জুড়ে দেয় আদালত, এমনকি আসামী নিজেও জামিন পাওয়ার জন্য নিজ থেকে আদালতের কাছে শর্তসাপেক্ষে জামিন আবেদন করে থাকে।
কিন্তু একাধিক মামলায় উচ্চ আদালত এরকম শর্ত আরোপকে অবৈধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে।ধারা ৪৯৯ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিতে পারবেন বন্ডের(bond) মাধ্যমে অথবা শিউরিটির(surety) মাধ্যমে। ধারা ৪৯৯ কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আদালত অন্য কোন শর্ত আরোপ করতে পারে না। আব্দুস শুকুর বনাম রাষ্ট্র(২৫ ডিএলআর ১১৯), এ মামলায় নিম্ন আদালত এ শর্তে জামিন দেয় যে আসামী শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না। কিন্তু হাই কোর্ট ডিভিশন এ ধরনের শর্ত আরোপকে অবৈধ বলে রায় দেয় এবং একই সাথে এটাও বলে যে ধারা ৪৯৯ আদালতকে এরকম শর্ত আরোপ করার ক্ষমতা দেয় না। এমনকি নারী শিশু ট্রাইবুনাল এক মামলায় আসামীকে মামলা আপোস করার শর্তে জামিন দিলে উচ্চ আদালত এরকম শর্ত আরোপকে অবৈধ বলে রায় দেয়(হোসাইন মো. রাজিব বনাম রাষ্ট্র, ৬৩ ডিএলআর ৪৪৭)। শুধু তাই নয়, আসামী নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শর্তজুড়ে দিয়ে আদালতের কাছে জামিন আবেদন করলেও আদালত সে শর্ত গ্রহণ করে জামিন দিতে পারে না বলে উচ্চ আদালতের অনেক নজির রয়েছে(২৫ ডিএলআর ১১৯,প্যারা-৩)।ভারতের উচ্চ আদালত কেশব নারায়ণ বনাম রাষ্ট্র( এআইআর ১৯৮৫ এসসি ১৬৬) এ মামলায় বলেছে, জামিন মঞ্জুর করার সাথে শর্ত আরোপ করা জামিন প্রত্যাখ্যান করার মতোই।
সিআরপিসি ১৮৯৮, জামিন ও বন্ড সংক্রান্ত অধ্যায় বিশ্লেষণ করলে এটা বুঝা যায় যে, জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে বন্ড ও শিউরিটির বাইরে অন্য কোন শর্ত আরোপ করার ক্ষমতা আদালতের নেই। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের এমন অনেক নজির রয়েছে যেখানে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়াকে আদালত অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন যেটা ইতিপূর্বে বিভিন্ন কেস ল এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি নীতি হলো, “Presumption of Innocence” অর্থাৎ একজন আসামীকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিরপরাধ বলে ধরে নিতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে।
একজন আসামীর জামিন পাওয়া না পাওয়ার সাথে তার সাংবিধানিক অনেক অধিকার জড়িত রয়েছে। আর এজন্যই কোন একজন আসামীকে বা কোন একজন সন্দেহভাজনকে আটক করলে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ও উচ্চ আদালত কতৃক প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসরণ করলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
লেখকঃ সোয়েব আক্তার, শিক্ষার্থী, ৩য় বর্ষ এলএলবি(সম্মান),আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।E-mail: sasehab833488@gmail.com