সব
facebook apsnews24.com
পারিবারিক আদালত, নারীর অধিকার এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা - APSNews24.Com

পারিবারিক আদালত, নারীর অধিকার এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পারিবারিক আদালত, নারীর অধিকার এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ সালে জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশ দ্বারা পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশ জারির সময় বা আদালত প্রতিষ্ঠা করার সময় বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলনা, বৈধ সংসদ ছিলনা। জনপ্রতিনিধিদের মতামত, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতামত, অভিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফতি,মাওলানা,সাধারণ ভুক্তভুগি নারীদের মতামত গ্রহন না করেই এই অধ্যাদেশ বিগত ১৫/০৬/১৯৮৫ ইং তারিখে কার্যকরী করে পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের অধীনে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৪৮৮ ধারার বিধান, ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন,খাগড়াছড়ি জেলা সমুহে পারিবারিক কোন আইন প্রযোজ্য নয়। এই জেলা সমুহের নারীগণ কেন এই আইনের সুবিধা পাবেন না তার কোন ব্যাখ্যা এই অধ্যাদেশে দেয়া হয় নাই।

ইতিপুর্বে এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিটি মুন্সেফ আদালতের বিচারক কে পারিবারিক আদালতের জজ হিসেবে গন্য করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৯ সালের ৩০ নং আইন দ্বারা মুন্সেফ শব্দের পরিবর্তে সহকারী জজ পদবী দেয়া হয়েছে। পারিবারিক আদালতের জজদের পৃথকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়না। সহকারী জজগণকে দেওয়ানি আদালতের বিচার কার্য পরিচালনা করার পাশাপাশি পারিবারিক জজ হিসেবেও বিচার কাজ পরিচালনা করতে হয়।

পারিবারিক জজগণ ৫টি বিষয়ের উপর বিচার কার্য পরিচালনা করেন সেগুলো হলে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার,দেনমোহর, ভরণপোষন বা খোরপোশ, শিশু সন্তানদের অভিভাকত্ব ও তত্বাবধান। ইতিপুর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার,দেনমোহর, বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার ছিল দেওয়ানি আদালতের। স্ত্রী ও সন্তানদের ভরনপোষন বা খোরপোষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ায় প্রথম শ্রেনির ম্যাজিস্ট্রেটের ছিল। শিশু সন্তানদের অভিভাকত্ব ও তত্বাবধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার ছিল জেলা জজের এবং নাবালকের সম্পত্তি বিক্রয় বন্ধক বা যেকোন প্রকারের হস্তান্তর করার জন্য নাবালকের নিযুক্তীয় অভিভাবক কে জেলা জজের পারমিশন নিতে হত। বর্তমানে জেলা জজদের পরিবর্তে পারিবারিক আদালতের জজগণ এই অনুমতি দিয়ে থাকেন। বর্তমানে উত্তরাধিকার বিষয়ে সাকশেষন সার্টিফিকেট পেতে হলে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবেদন করতে হয়।

১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের অধীনে দেনমোহর,ভরনপোষন,খোরপোশ এর মামলায় বেশী হয়। কে ভরন পোষন পাবে-স্ত্রী,সন্তান বাবা-মা দাদা-দাদীর নিকট থেকে। স্ত্রী পাবে স্বামীর নিকট থেকে, সন্তান পাবে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর নিকট থেকে। মুসলিম আইনে জারজ সন্তান কোন খোরপোষ পাবেনা। তবে জারজ সন্তান তার গর্ভধারিনী মায়ের নিকট থেকে সম্পত্তি প্রাপ্ত হবে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৩ ধারায় উল্লেখ আছে ধর্ষনের ফলে কোন নারী সন্তান জন্ম লাভ করলে উক্ত সন্তানের ভরন পোষনের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে। উক্ত সন্তানের ভরনপোষনের ব্যয় তার বয়স একুশ বছর পর্যন্ত প্রদেয় হবে। তবে একুশ বছরের অধিক বয়স্ক কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে তাহার বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এবং পুত্র সন্তান এর ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভরনপোষনের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত প্রদেয় হবে।

পারিবারিক আদালতে মামলা করার জন্য নির্ধারিত কোর্ট ফিস আছে ২৫/- টাকা, যদিও এই আইন বিশেষ আইন তবুও কোন কোন কোর্টে সেরেস্তাদার ৬০ টাকা কোর্ট ফিস না দিলে মামলা গ্রহন করতে চান না। পারিবারিক আদালতের মামলায় আরজি ও জবাব দাখিলের পর পরই উভয় পক্ষের আরজি, জবাব, দাখিলকৃত কাগজপত্র পরীক্ষান্তে আদালত বিরোধীয় বিচার্য বিষয় নির্ধারন করে পক্ষ গনের মধ্যে আপস মীমাংসার চেষ্টা করবেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অধিকাংশ মামলায় বিচারক আপস মীমাংসার চেষ্টা করেন না, সাক্ষ্য প্রমান শেষ হওয়ার পর পারিবারিক আদালত পক্ষগনের মধ্যে আপস বা মীমাংসার জন্য আরও একবার চেষ্টা করবেন কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ পারিবারিক আদালতের বিচারকগণ আপসের চেষ্টা করেন না বরং মামলার নিষ্পত্তির দিকেই বিচারকের আগ্রহ বেশী দেখা যায়। এর পরে বিবাদী পক্ষ আপিল করবেন, নারীরা সেখানে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন এতে করে নানীরা তাদের দাবী আদায়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হয়। পারিবারিক আদালত থেকে কোন নারী দেনমোহর,খোরপোষ বা সন্তানের খোরপোষের রায় ডিক্রি পাওয়রা পরে কেন ডিক্রি জারির মোকদ্দমা করতে হয় আলাদাভাবে? রায় ও ডিক্রির আলোকে একই আদালতে রায় অনুযায়ী ডিক্রি কৃত অর্থ আদায়ের জন্য শুধু একটা দরখাস্ত দিলে অসুবিধা ছিল কোথায়? অথচ আইন প্রনেতাগন ডিক্রি জারি করার জন্য আলাদা কেস করার যে বিধান করেছেন তার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়না। এমনিতেই একজন নারীর রায় ডিক্রি পেতে সাক্ষ্য প্রমান আদালতে উপস্থাপন করতে হয় স্বামী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন বা নানা-নানীর বাড়িতে থাকতে হয়, তার উপর আবার রায়-ডিক্রি পেয়ে নতুন করে ডিক্রি জারির মামলা করতে কতই না পেরেশানি হয়। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বর কনে এক অপরকে তালাক দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর চেয়ারম্যানকে তালাকের নোটিশ দিলে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌর চেয়ারম্যান তালাকের নোটিশ পাওয়ার পরে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করে বর বা কনের মধ্যে আপস মীমাংসার চেষ্টা করবেন কিš’ বাস্তবে তা করা হয়না। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন উত্তরাধিকার নির্ধারনে যে বিধান করা হয়েছে তা সঠিকভাবে করা হয় নাই । পিতার আগে পুত্র বা কন্যা মারা গেলে নাতনীদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পত্তির অধিকারী করা হয়েছে। পিতার আগে পুত্র মারা গেলে অসহায় পুত্রবধু কোন সম্পত্তি পাইনা, এই আইনে পুত্রবধুকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মেয়েরা এই সম্পত্তি চাইতে গেলে নানা প্রকার গঞ্জনা,অবজ্ঞা ও ভয়ভীতি দেখায় অন্যান্য ওয়ারিশগণ। অধিকার আদায়ের জন্য নারী সম্মিলিতভাবে ইতিপূর্বে কোন জোরালো চেস্টা করে নাই। বর্তমানে কিছু সংখক উ”চশিক্ষায় শিক্ষিত নারীগণ নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন,টেলিভিশনে বক্তব্য উপস্থাপন করেন কিš’ রাজপথে,সংসদে নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে এখনোও সক্ষম হয়নি। ভবিষ্যতে নারীগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্টার জন্য সচেষ্ট না হলে নারীর অধিকার আদায়ের পথই রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে যা সভ্য সমাজে আদৌ কাম্য হতে পারেনা।

লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj