সোয়েব আক্তার
সিভিল কিংবা ক্রিমিনাল কোন একটি মামলা আদালতে বিচার চলাকালীন সময়ে উক্ত মামলার সাথে জড়িত সাক্ষ্য গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মামলার হার জিত অনেকটা সাক্ষ্য ও সাক্ষীর উপর নির্ভর করে। আমাদের সমাজে সাধারণ জনগণের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, একজন শিশু সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যোগ্য/সক্ষম নয়। প্রচলিত এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। কেন সত্য নয় সেটার আইনগত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশে সাধারণত কোন কোন বিষয়গুলো সাক্ষ্য হিসেবে এবং কোন কোন ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে নিয়ে আসা যাবে সে বিষয়টি পরিচালিত হয় “সাক্ষ্য আইন ১৮৭২” অনুযায়ী। এ আইনের অধ্যায়-৯ এ কারা কারা আদালতে সাক্ষী হতে পারবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। ধারা ১১৮ কে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বুঝা যাবে একজন শিশু আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা।
ধারা ১১৮ কে ২টা অংশে ভাগ করা যায়ঃ
(১) সকল মানুষ সাক্ষ্য দিতে যোগ্য।
(২) যদি আদালত মনে না করে কোন ব্যক্তি অল্প বয়স, বেশি বয়স অথবা শারীরিক/মানসিক কোন জটিলতার কারণে তাকে করা প্রশ্ন বুঝতে ও যুক্তিযুক্তভাবে উত্তর দিতে অক্ষম অথবা অন্য কোন কারণ রয়েছে।
ধারা ১১৮ থেকে খুব সহজেই বুঝা যায় এ ধারা অনুযায়ী সবাই সাক্ষী দিতে পারবে তবে তাকে একটা পরীক্ষায় পাশ করতে হবে আর সেটা হলো সাক্ষ্য প্রদান করার যোগ্যতা/সক্ষমতা।
রাম জোলাহা বনাম ই (১৮ সিআর এলজে ৫৪১), এ মামলায় আদালত বলেছেন, কেউ সাক্ষ্য দিতে যোগ্য কিনা সেটা নির্ভর করে তাকে করা প্রশ্ন বুঝতে পারা ও যুক্তিযুক্তভাবে উত্তর দেয়ার উপর। জালওয়ান্তি লোদিন বনাম রাষ্ট্র (১৯৫৩ সিআর এলজে ১৩৪৪), এ মামলায় আদালত শিশু সাক্ষ্যের উপযুক্ততা নিয়ে বলেছেন শিশুকে করা প্রশ্ন সে বুঝতে পারলে এবং যুক্তিযুক্তভাবে উত্তর দিতে পারলে শিশুটি আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য উপযুক্ত।
তবে মনে রাখতে হবে শিশু সাক্ষ্যের যোগ্যতা/সক্ষমতা(competency) এবং বিশ্বাসযোগ্যতা(credibility) কিন্তু এক বিষয় নয়।
যোগ্যতা বলতে একজন শিশু আদালতে সাক্ষ্য দিতে যোগ্য/সক্ষম কিনা সেটিকে বুঝায় আর বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে তার দেয়া সাক্ষ্যকে কতটা সত্য ধরে নিয়ে আদালত তার রায় দিবে সেটিকে বুঝাবে।
যোগ্যতা/সক্ষমতা নির্ণয় করার জন্য একটি পরীক্ষার কথা ইতিমধ্যে বলেছি। এটা হতে পারে “Voir Dire” পরীক্ষা, এটার মাধ্যমে আদালত উক্ত শিশুকে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়ের বাইরের বিষয় নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে পারে (যেমনঃ তার নাম কি, বাসা কোথায়, কোন শ্রেণিতে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি)। আর এর মাধ্যমে একজন বিচারক সহজেই বুঝতে পারবে শিশুটিকে করা প্রশ্নের ধরণ সে কতটা বুঝতে পারছে এবং কতটা যুক্তিযুক্তভাবে উত্তর দিতে পারছে। এটার উপর নির্ভর করে আদালত একজন শিশুর সাক্ষী হওয়ার যোগ্যতা/সক্ষমতা নির্ণয় করতে পারে।
এবার আসি বিশ্বাসযোগ্যতায়, অনেক সময় দেখা যায় একজন শিশুকে আগে থেকেই সবকিছু শিখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে যদি আদালতের কাছে এ বিষয়টি প্রকাশ পায় অথবা আদালত বিষয়টি বুঝতে পারে তাহলে সেই শিশু সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। ঠিক কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে পুরো সাক্ষ্য থেকে যদি পূর্বে শিখানো বিষয়টি আলাদা করা যায় তাহলে বাকি অংশটুকু আদালত সত্য বলে ধরে নিতে পারে।
অর্থাৎ সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ অনুযায়ী সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নির্ধারিত কোন বয়সসীমা নেই। একজন শিশু, একজন বয়স্ক মানুষ, এমনকি একজন পাগলও চাইলে আদালতে সাক্ষী হতে পারবে তবে এজন্য অবশ্যই তার সাক্ষী হওয়ার যোগ্যতা/সক্ষমতার পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আর এ যোগ্যতা/সক্ষমতা পরীক্ষা করার দায়িত্ব আদালতের উপর অর্পন করা হয়েছে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদালতকে অবশ্যই সতর্কতার সাথে এ বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে।
সোয়েব আক্তার
শিক্ষার্থী, ৩য় বর্ষ এলএলবি(সম্মান),
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।