এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
নাবালক সন্তানের সবচেয়ে আপনজন ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল পিতা-মাতা। সন্তানের বেড়ে উঠা, গড়ে উঠাসহ মানসিক বিকাশে পিতা-মাতা যেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু পিতা-মাতার দ্বন্ধে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলে সন্তানকেও বিচ্ছেদ হতে হয়। হয় পিতার তত্ত¡াবধানে নয়তো মায়ের তত্ত¡াবধানে। আইন পেশায় থাকার সুবাদে বিচ্ছেদ সম্পর্কিত মামলা ও সালিশ নিষ্পত্তির অভিজ্ঞতা পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চাই। স্ত্রীর পক্ষে অভিযোগগুলো হচ্ছে, স্বামীর সন্দেহজনক মানসিকতা, পরকীয়া, স্বামী প্রবাসে থাকা, যৌতুক, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত ইত্যাদি। অন্যদিকে স্বামীর পক্ষের অভিযোগ- স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় চলা, বদমেজাজ, পরকীয়া, সংসারের প্রতি কম মনোযোগ দেয়া, ধর্মকর্মে উদাসীনতা, বন্ধ্যাত্ব, শশুড়-শাশুড়ীর সাথে খাপ না খাওয়া ইত্যাদি। উভয়ের মধ্যে তালাক হওয়ার পর শুরু হয় ছেলে আর মেয়ে সন্তান নিয়ে টানাটানি। সেই দ্বন্ধ গড়ায় রীতিমতো আদালতে।
একজন নারী। চরম বাস্তবতা উপলব্ধি থেকে হয়েছেন ডিভোর্স ল’ইয়ার। তাঁর জীবন কাহিনী ফেসবুক ষ্ট্যাটাস থেকে নিয়েই আজকের নিবন্ধের ইতি টানছি। সেই দিনটির কথা মেয়েটি আজও ভুলেনি। কোর্টে বাবা-মায়ের সেপারেশনের সময় জজ সাহেব মা’কে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কাকে চান? ছেলে না মেয়েকে? মা তখন তার ছেলেকে চেয়েছিল, মেয়েকে চায়নি। মেয়ে বলে বাবাও তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কারণ তিনি আবার বিয়ে করে নতুন সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, অযথা মেয়েকে নিয়ে নতুন সংসারে বোঝা বাড়াতে চাননি।
আদালতের বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে বসে যখন অঝোরে কাঁদছিল মেয়েটি, তখন বুকে আগলে ধরেছিলেন এক লেডি কনস্টেবল। আশ্রয় দিয়েছিলেন তার বাড়িতে। কিন্তু তার মাতাল স্বামীর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল ১০ বছর বয়সী মেয়েটির উপর। শিশু বয়সে অত কিছু না বুঝলেও কেমন যেন খারাপ লাগতো ওর। রাতে যখন আন্টি (মহিলা পুলিশ) বাসায় ফিরতেন, মেয়েটি তাকে সব বলে দিত। পুলিশ মহিলা দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। অতঃপর মেয়েটির নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি তাকে একটা এতিমখানায় রেখে আসলেন। যাবার সময় মেয়েটির দু’হাত জড়িয়ে ধরে যেমন করে কাঁদলেন, মেয়েটির মাও তাকে রেখে যাওয়ার সময় ওভাবে কাঁদেনি।
দিন যায়, মাস আসে, আসে বছর-এভাবে এতিমখানাতে কাটতে থাকে মেয়েটির জীবন। খুব অসহায় লাগতো ওর। বাবা মা বেঁচে থাকতেও যে শিশুকে এতিমখানায় থাকতে হয় তার থেকে অসহায় বুঝি আর কেউ নেই। বছর দু’য়েক পরের কথা। এক নিঃসন্তান ডাক্তার দম্পতি মেয়েটিকে দত্তক নেন। জীবনটাই পাল্টে গেল ওর। হেসে খেলে রাজকীয়ভাবে বড় হতে লাগল মেয়েটি। ওর নতুন বাবা মা তাঁদের মতই ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটির একগুঁয়ে ইচ্ছে ছিল একটাই, সে ল’ইয়ার হবে। আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমতে মেয়েটি এখন একজন ডিভোর্স ল’ ইয়ার। যারাই তাঁর কাছে তালাকের জন্য আসে, আগেই সে বাচ্চার কাস্টোডির জন্য তাদের রাজি করায়। কারণ বাবা মা ছাড়া একটা শিশু যে কতটা অসহায়, তা ওই মেয়েটি ছাড়া কেউ জানে না!!
ডিভোর্স ল’ ইয়ার মেয়েটি চেম্বারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। হঠাৎ একটা নিউজে তাঁর চোখ আটকে গেল। এক বৃদ্ধা মহিলাকে তার ছেলে আর বউ মিলে বস্তায় ভরে রেলস্টেশনে ফেলে রেখে গেছে। পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। নিচে বৃদ্ধা মহিলার ছবি দেয়া। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছিল। কাছে এনে ভালো করে ছবিটা দেখলেন। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। এ-তো সেই মহিলা যে তাকে অনেক বছর আগে আদালতে ছেড়ে গিয়েছিল, তার মা। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটে গেলেন হাসপাতালে।
সেই মুখটা কিন্তু চেনার উপায় নেই। চামড়াটা কুঁচকে আছে, শরীরটা রোগে শোকে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগছে, ভেতরটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আচ্ছা, সেদিন কি তার একটুও কষ্ট লাগেনি, যেদিন তার ১০ বছরের শিশু কন্যাটি মা-মা করে পিছু পিছু কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াচ্ছিল? হয়তো লাগেনি। নয়তো এভাবে ফেলে যেতে পারতো না।
একবার মেয়েটি ভেবেছিল চলে যাবে। হঠাৎ দেখে তিনি ঘুম ভেঙে চোখ পিটপিট করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝল চিনতে পারেননি, চেনার কথাও নয়!! মেয়েটি এবার পরিচয় দিল। কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। নিজের কৃতকর্মের জন্য বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে। নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাকে।
মাকে পাওয়ার পর বাবার জন্যও মনটা উতলা হয়ে উঠে। মায়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাবার অফিসে যোগাযোগ করে। জানতে পারে, কয়েক বছর আগেই রিটায়ার্ড করেছেন তিনি। বাসার ঠিকানায় গিয়ে দেখে উনি নেই। উনার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করে জেনে নয়, রিটায়ার্ড করার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়েন। অযথা একটা রুম দখল করে নোংরা করত, তাই বিরক্ত হয়ে ছেলেমেয়েরা তাকে একটা সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, অযথা ঘরে বোঝা বাড়িয়ে কি লাভ।
ওদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে গেলেন। চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, মনে হলো একটা জীবিত লাশ পড়ে আছে বিছানায়। পাশে বসে হাতটা ধরলেন, পরিচয় দিতেই মুখ ফিরিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
বাবা-মা এখন সেই মেয়েটির সাথে একই বাড়িতে আছেন। একসময় তারা মেয়েটিকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটি পারিনি ছাড়তে। হাজার হোক তাঁর বাবা-মা তো।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।, Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮