রায়হান কাওসার
আগেকার দিনে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের প্রধানকে বলা হতো সম্রাট বা মহারাজাধিরাজ। সুবিশাল এলাকা জুড়ে ছিল যার সাম্রাজ্য; ছিল তালুকের পর তালুক। সম্রাটের অধীনে থাকত ছোট ছোট অনেক রাজা। এসব রাজার অধীনে থাকত হাজার হাজার খেটে-খাওয়া প্রজা। থাকত বৈদ্য, থাকত স্থানীয় ছোট-খাট ব্যবসায়ী এবং ধর্মীয় শ্রেণী-গোত্রীয় লোকজন।
সেইসময় প্রজাদের বেশির ভাগই ছিল চাষা-ভোষা। তারা ভূস্বামী বা তালুকদারদের জমি পত্তনি নিয়ে চাষাবাদ করে খেত। একজন রাজার করায়ত্বে থাকত তালুকের পর তালুক। সেগুলো দেখাশুনা করত স্থানীয় ভূ-স্বামীগণ- যাদেরকে বলা হতো তালুকদার। বড় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জমি-জমাকে বলা হতো তালুক। যেদিকেই চোখ যাবে, সবই আপনার জনাব; আর কারো নয়। তালুকদারগণ সেই ভূখন্ড গ্রামের চাষা-ভোষাদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন; তবে মাগনা নয়। বছর শেষে জমি ভোগ করার জন্য দিত হতো ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ কিংবা মুদ্রা। না দিতে পারলে খেতে হতো তালুকদারের লোকের হাতে বেধড়ক পিটুনি এবং হারাতে হতো চাষাবাদ করে খাওয়া জমিটুকু। খাজনা বা ফসলের নির্দিষ্ট অংশ আদায় করার জন্য তালুকদারদের ছিল নিজস্ব কিছু লোকজন।
লোকে বলে, “বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়”- তালুকদারদের এই লোকগুলো ছিল ঠিক তেমনই। বেজায় ফাজিল। এদের চাল-চলন দেখে মনে হতো এরাই তালুকদার। সেই জামানাটা কৃষকদের জন্য ছিল অনেক কঠিন। এত কলকারখানা ছিল না সেই সময়, ছিল না প্যান্ট-শার্ট আর টাই পরে এসি রুমে বসে এত চাকুরী করার সু্যোগ। সেই সময় ছিল না এত ওপেন প্রেম ভালবাসা। একা একা একজন পুরুষ ও একজন মহিলা কথা বলতে দেখলেই বসানো হতো বিচার। দেওয়া হতো বেধড়ক পিটুনি। ইচ্ছেমত পিটুনি দিতে সেই সময়কার মাতব্বররা ছিল বেশ ওস্তাদ। পিটুনির চোটে যেটি বলতে বলা হতো, অসহায় লোকগুলো ঠিক সেটিই বলে দিত। কিছু লোক ছিল যারা পিটুনি দেখে এবং বিচারকদের অশ্লীল প্রশ্ন শুনে পৈশাচিক মজা নিত। যখনই লোকজন শুনত যে, গাঁয়ে কোথাও একটি বিচার বসেছে, উৎসুক এবং মজা নিতে আসা লোকজনের অভাব হতো না তখনকার দিনে।
সেই সময় গ্রামের মেয়েরা বেশ সহজ-সরল ছিল। তবে কিছু বজ্জাৎ ও ঝগড়াটে মহিলা যে ছিল না তা নয়। প্রতি গ্রামে ঝগড়ার জন্য বিখ্যাত দু-তিনটা মহিলা থাকত। স্বামী বা পুরুষ লোক বাড়িতে না থাকলে এদের আর দেখে কে! মহিলাগুলো হাল্কা কাপড় উঁচু করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হতো। মহিলাগুলো মুখেই হল-বল, হাতাহাতি কিংবা সম্মুখ লড়াইয়ে তারা যেত না খুব একটা। তবে, চুল ছেঁড়া-ছেঁড়ি যে একেবারে হতো না তা নয়। পাশের বাড়ির লোকজন ও বাচ্চা-কাচ্চারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত ও মনে মনে মজা নিত। মানুষগুলো ছিল সত্যিই আজব প্রকৃতির। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে, অথচ দুই পক্ষকে ক্ষান্ত দেওয়া কিংবা বিরত রাখার জন্য কোন চেষ্টা করবে না। আগেকার দিনে মূর্খ, লুইচ্চা-বাটপার যাই হোক না কেন ভূ-স্বামী এবং বেশি লাঠির মালিকরাই হতো সমাজের মাতব্বর। ‘লাঠি’ মানে বংশ। যাদের বংশ বড় বা লোকজন বেশি তাদেরকেই মাতব্বর শ্রেণীর লোক বলে বিবেচনা করা হতো। তবে সময় অনেক বদলেছে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। আগেকার দিনের রাজনীতির অবয়ব যেমনটি ছিল, এখন ঠিক তেমনটি নেই।
আগেকার দিনের হিসেবে, রাজনীতি মানে হলো” রাজার নীতি”। অর্থাৎ রাজনীতি মানেই রাজ-রাজড়াদের ব্যাপার। রাজনীতি ব্যাপারটা সমাজের সবচেয়ে উঁচু শ্রেণীর মানুষদের জন্যই। অর্থাৎ, রাজনীতি ছিল মাতব্বর শ্রেণী বা তার উপরের লোকজনদের হাতে; চাষা-ভোষাদের হাতে নয়। আগেকার দিনে ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচনের চল ছিল না। যে রাজ্য জয় করত, সেই ছিল নেতা। তার কথাই ছিল আইন। তার ইচ্ছাতেই রাজ্য চলত।
তবে, বর্তমানকালে, রাজনীতি আরেকটু উঁচু সমাজ থেকে একধাপ নিচে নেমে সাধারণ জনতার মধ্যেও এসেছে কিছুটা। এখনকার সময়ে, বলা হয়ে থাকে দেশের মালিক রাজা নয়, জনগণ।আগে ছিল রাজতন্ত্র, বর্তমানে হয়েছে প্রজাতন্ত্র। তবে, প্রজাতন্ত্র বলা হলেও প্রজাদের হাতে ক্ষমতা এখনও তেমনটা নেই। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। এখন জনগণই ভোট দিয়ে রাজার জায়গায় প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। আর জনগণের নির্বাচিত স্থানীয় মাতব্বরগণ বা এমপিগণ জনগণের পক্ষে রাজদরবার তথা সংসদভবনে কথা বলেন। তবে বর্তমানকালে, ছা-পোষা জনগণের হাতে রাষ্ট্রের মালিকানা তুলে দেওয়া হলেও এরা যোগ্য ও শিক্ষিত নেতা নির্বাচনে সব সময় পারদর্শী হয়ে ওঠে না। স্থানীয় ছোট-খাট নেতাদের কু-প্রভাব, নাগরিকদের দরিদ্রতা, অশিক্ষাসহ নানা সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে জনগণ সব সময় নিজ এলাকার জন্য কল্যাণমুখী নেতা নির্বাচিত করতে পারে না।
ফলে, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দ্রুত পরিবর্তন আনাও সম্ভব হচ্ছে না। সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে। অতি অল্প সময়ে সংস্কৃতিকে একটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উৎকর্ষতার জন্য আরও একটু সময় দিতে হবে। তবে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যখন আরেকটু প্রবীন হয়ে উঠবে, তখন হয়তবা আরও কিছু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব। ততদিনে বাইরের জগৎ সম্পর্কে নাগরিকগণ আরও বেশি জানবে, আরও বেশি শিক্ষিত হবে, অভাবও কিছুটা কমে যাবে। জনগণ অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে হবে আরও বেশি স্বাধীন। ফলে, নেতাদের নানা কু-প্রভাব ও প্ররোচনায় তারা খুব বেশি প্রভাবিত হবে না তখন।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, Email: raihankawsardu@gmail.com
মতামতের জন্য লেখকই দায়ী থাকিবেন।