অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন
সমঝদার লোক হলে আপনার জানার কথা যে, বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের একটি ধারা আছে যেখানে অপরাধটি করতে যেয়ে সফল হলে কোন বিচার হবেনা; তবে করতে যেয়ে ব্যর্থ হলে শাস্তির বিধান আছে। হ্যাঁ, আমি আত্মহত্যা চেষ্টার কথা বলছি। যে মৃত্যুকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য মানুষের প্রাণান্ত চেষ্টা, সেই মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করতে অস্ট্রেলিয়া থেকে সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ডেভিড গুডাল। কারণ সুইজারল্যান্ডে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ নয়! কিন্তু পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ আত্মহত্যা নয় বরং জন্ম ও জীবনকে প্রাণপণে প্রাধান্য দেন। জীবনকে সবাই আরাধ্য বিবেচনা করেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে নতুন সন্তান জন্ম দিলে সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে জন্মহার ঋণাত্মক। তাদের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে তারা চিন্তিত থাকে। তাই কিছু কিছু দেশ সহজ শর্তে অভিবাসী গ্রহণ করে। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, আপনার বেচেঁ থাকার অধিকার আছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ অর্থাৎ আত্মহত্যার অধিকার নেই। আপনি কী ভাবছেন এই বিষয়ে? আপনার মতে কি আত্মহত্যার অধিকার থাকা উচিৎ?
আত্মহত্যার বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটঃ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ আপনার বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও, আপনার স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ৩০৯ ধারা মারাত্মকভাবে কেবল নিরুৎসাহিতই করেনা বরং শাস্তির বিধান করে। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ” আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।” এবং দণ্ডবিধি,১৮৬০ এর ৩০৯ ধারায় বলা হয়েছে, ” কোন ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে এবং অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কার্য করে, তবে উক্ত ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে”। মনে রাখবেন আপনার বেঁচে থাকার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার যা বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত ও স্বীকৃত। আপনার স্বাভাবিক বেঁচে থাকার পথ কোনোরুপ বাধাগ্রস্ত হলে অত্র সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ আপনাকে ১০২ অনুচ্ছেদ বলে মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে হাইকোর্টে মামলা করার অধিকার দেয়।
আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানঃ
এমিল দুর্খেইম-এর ” ল্যা সুইসাইড ” বইয়ে তিনি আত্মহত্যার পেছনে লিঙ্গ, বিবাহ, ধর্ম, বসবাসের অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক নৈরাজ্যকে কারণ হিসেবে মোটাদাগে মূল্যায়ন করেন। সেই সময়ে আত্মহত্যা সম্পর্কিত প্রচলিত কিছু মত ছিল, যেমন; মানুষ আত্মহত্যা করে জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, তাপমাত্রার প্রভাব কিংবা অনুকরণপ্রিয়তা থেকে। সেগুলোকে বাদ দিয়ে তিনি মানুষের বাস্তব জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেন।
আমাদের দেশে চাকরি ব্যর্থতা, প্রেমে ব্যর্থতা, আত্মসম্মানে আঘাতসহ নানা আবেগিক কারণে আত্মহত্যা সংঘটিত হয় বলে দেখা যায়। এছাড়াও যে সকল মানুষ মৌলবাদীভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় পরম বিশ্বাস করে, তারাও আত্মহত্যাকে একান্ত নিজস্ব অধিকার বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ রাষ্ট্র তাদের এই অধিকার স্বীকার করেনা।
রাষ্ট্র কেন আত্মহত্যা সমর্থন করেনা?
রাষ্ট্রের প্রধান চার উপাদানের মধ্যে জনগণ হলো সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি দেশের জনগণ সে দেশের জাতীয় শক্তির অন্যতম স্তম্ভ। যেদেশের নাগরিকেরা অধিক সুনাগরিক, হিসেব করলে দেখবেন সেইসব দেশই উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করে। জীবনের জন্য সকল আয়োজন। মানুষের মূল্য অমূল্য। এই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার কৌশলে অন্যান্য প্রাণীকূল ধরাশায়ী। কখনো কোনো বন্য হাতির দল কোন মানুষকে আক্রমণ করলে, তাকে বাঁচাতে হাতিদের হত্যা করা হয়। কিন্তু মানুষটিকে বাঁচানোই মূখ্য বিবেচ্য হয়। এর আইনি ভিত্তির চেয়েও বড় ভিত্তি হলো মানবিক ভিত্তি। মানুষের প্রাকৃতিক মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারেনা। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি জীবনকে বাচিঁয়ে রাখতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতো এতো গবেষণা ও চেষ্টা। জীবন দামী। আদুরে জীবন রক্ষায় তাই প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হয়। খেয়াল করুন, পৃথিবীকে আলোকিত করা মানুষেরা যদি অবাধে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হতো, জগতের বহু কল্যাণমূলক কাজই হয়তো সাধিত হতো না। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।”
আত্মহত্যায় ধর্মীয় বাঁধাঃ
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো। আল্লাহর পক্ষে তা সহজ সাধ্য।(সূরা নিসা ২৯-৩০)। ইহুদিদের ধর্মমতেও আত্মহত্যা একটি জঘন্য ধরনের পাপ। এটি এমন একটি কাজ যা মানবজীবন যে স্বর্গীয় দান তা অস্বীকার করে এবং মনে করা হয় এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জীবনকালকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য তার মুখমণ্ডলে চপেটাঘাত। ঠিক একইভাবে খ্রিষ্টানদের বাইবেলে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা না হলেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মতত্ত্ব মতে, আত্মহত্যা নিরপেক্ষভাবে একটি পাপ যা নিজেকে হত্যা না করার নৈতিক আদেশের লঙ্ঘন। বৌদ্ধদের ধর্মমতে আত্মহত্যাকে নেতিবাচক কাজ গণ্যে জীবননাশ হতে নিজেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মমতে আধ্যাত্মিকভাবে আত্মহত্যা অগ্রহণযোগ্য। সাধারণভাবে ধর্মটিতে আত্মহত্যাকে অহিংস আচরণের লঙ্ঘন বিবেচনা করা হয় এবং সে কারণে আত্মহত্যাকে অপরকে হত্যা করার মতো সমধরনের পাপ বিবেচনা করা হয়। তাদের কিছু ধর্মশাস্ত্রে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর পরিণতি হলো দানবরূপে আবির্ভাব। তাই দেখা গেলো, পৃথিবীর বহুল প্রচলিত ধর্মগুলো আপনার আত্মহত্যার অধিকার স্বীকার করে না।
তাই বলি, আপনার সাধের জীবনের মায়া আকস্মিক কারণে আপনি হারাতে পারেন, কিন্তু আপনার জীবন শুধু আপনার নয়! আপনার পরিবার, সমাজ ও দেশ আপনার জীবনের উপর দাবী রাখে। তাই সরকার এতো করে তাড়িয়ে খেদিয়ে আপনাকে ঘরে রাখতে চায়। আমাদের দায়িত্ব হলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করা। জীবন ভালোবাসুন। জীবনকে ভালোবাসলেই জীবন আমাদের ভালোবাসায় মাখামাখি করে দেবে!
লেখকঃ আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। তিনি ” আমাদের স্বপ্ন ” সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক। প্রতিক্রিয়াঃ bellal.sincere@gmail.com