রায়হান কাওসার
১৮৮৬ সাল। আমেরিকার অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দিনে ১২ থেকে ১৫ ঘন্টা শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, দিনের আলো দেখার সুযোগ খুব কম। কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছেন। কাজ করলে খাওয়া, নইলে উপোস- এমনই অবস্থা ছিল সেই দিনগুলিতে। ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা মোটা টাকার মুনাফা গুণলেও অসহায় শ্রমিকদের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করত না। ১৮৬৫ সালে মানুষ দাস প্রথা থেকে মুক্তি পেলেও পুঁজিপতিদের নিকট তখনও তারাছিল দাসের মতই বাঁধা। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক এমনভাবে প্রদান করা হতো যেটি জীবন ধারণ করে কোনমতে বেঁচে থাকা যায় এমন। শ্রমিকরা নিজের কিংবা তাদের পরিবারের সম্ভাব্য বিপদের জন্য যে দুটি টাকা সঞ্চয় করে রাখবেন, তার সুযোগ ছিল না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মালিকরা তাদের দেখভালও করত না। হাতে সঞ্চিত টাকাও সেরকম থাকত না। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে থেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হতো অনেককে।
শিকাগো শহর। ০১ মে, ১৮৮৬ সাল। শ্রমিকরা দলে দলে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে যোগাদান করছে। আট কর্মঘন্টার দাবীতেতীব্র আন্দোলনের ডাক দিল তারা। টানা আন্দোলন চলল ০৪ মে পর্যন্ত। নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে সংঘর্ষে ০৩ মে ছয় জন শ্রমিক নিহত হলো এবং শত শত শ্রমিক আহত। ফলশ্রুতিতে, ০৪ মেশিকাগোর হে মার্কেট এলাকায় আবারও নির্ভীক শ্রমিকরা মুহুর্মুহু আন্দোলনে ফেটে পড়ল। আন্দোলনে বোম্বিং হয়ে ০৭ জন পুলিশ সদস্য এবং আরও চার জন শ্রমিক নিহত হলো। মারাত্মকভাবে আহত হলো হাজার হাজার শ্রমিক। শিকাগোর হে মার্কেট এলাকায় শ্রমিকদের উপর ঘটে যাওয়া সেই বিভীষিকাময় দিনগুলিকে স্মরণ করার জন্যই পালিত হয় আজকের মহান মে দিবস।
শ্রমজীবীদের জন্য তাৎপর্যময় এই দিনটিতেকিভাবে শ্রমিকরা শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবেন- সে বিষয়ে আরও বেশি চিন্তা ও আলোচনা করা দরকার। সেই বিভীষিকাময় দিন হতে ১৩৪ বছর পরেও আজ আমরা সকল ধরনের শ্রম-বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছি- এ কথা বলা যাবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও সরকারি এবং বেসরকারি চাকুরীর মধ্যে রয়েছে এক বিরাট বৈষম্য। একটি সরকারি চাকুরী পাওয়ার জন্য একজন চাকুরী প্রার্থী স্বেচ্ছায় ৮-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে রাজী থাকেন। তবুও তারা বেসরকারী চাকুরী করতে চান না- এটি কেন? তাদের যুক্তি হলো সরকারি চাকুরীতে বেতনের সাথে সাথে উপরি ইনকাম আছে। বিয়ে করতে গেলে পাত্রীর বাবা সরকারি পিয়ন পেলেও বেজায় খুশি। আর সরকারি প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরী হলে তো কথাই নেই। খুশি হয়ে শ্বশুর মশাই বলে বেড়াবেন-“জামাইয়ের ভাল উপরি ইনকাম আছে, বেতনের টাকায় হাত দেওয়া লাগেনা।”
অনেক বেসরকারি চাকুরীজীবী এক প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন চাকুরী করতে পারেন না। দু’এক বছর পর পর চাকুরী বদল করতে হয়। স্বেচ্ছায় বিদায় না নিলে নানা ধরনের টেকনিক্যাল প্রেসার দিয়ে ছাঁটাই করা হয় তাদের। অসহায়হয়েলোকটিতখন মনে মনে চিন্তা করেন, “ইশ! বয়স থাকতে যদি একটা পিয়নের চাকুরীও নিতাম, আজ বউ-বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় নামতে হতো না”। চাকুরীর মাঝ বয়সে একজন নাগরিক কেন এত অসহায় হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বেন? দেশের মন্ত্রী-এমপি-বিচারপতিরা কি এগুলা একবারও ভাবেন না? অন্যায়ভাবে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করলে সেটির বিচার পেতেও চলে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু তাই বলে কী তাদের জীবন থেমে থাকে? পেট কী বন্ধ থাকে?
বেসরকারি চাকুরীতে নাই কোন পেনশন, নাই কোন উপরি ইনকাম, নাই চাকুরীর নিশ্চয়তা। মালিকের ভাল না লাগলে বড়জোর দু-তিনমাসের নোটিশ। চাকুরী শেষ। পথে নামো এবার। কিন্তু কারো সরকারি চাকুরী এভাবে এক নোটিশে গেছে কিনা সেটি জানা নেই। আবার, সরকারি চাকুরীজীবীরা কোন অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন মামলা করা যায় না। সরকার মহোদয়ের পূর্বানুমতি লাগে। এগুলোকে কী বৈষম্য বলা যায় না?
পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানুষই অনন্য ও অপার সম্ভাবনাময়। ভাল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে আমরা কেউ কেউ জীবনেঅনেক দূরএগিয়ে যাই, আবার কেউ কেউ সেগুলির অভাবেবেশিদূর যেতে পারিনা। একজন মানুষের সফলতার পেছনে যেমন তার একার কৃতিত্ব নেই, তেমনি তারব্যর্থতার জন্যও সে একা দায়ী নয়। তার সফলতা ও ব্যর্থতার পেছনে তার পরিবার এবংসমাজের অবদান এবং দায়- দুটোই রয়েছে। একজন ব্যক্তি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে পারেনি বলে আজ সে দিন-মজুর কিংবা জুতা সেলাই করা মুচি। সেজন্য দিন-মজুর ও মুচি ভাইদেরলজ্জা পাবার কিছু নেই। কারণ, তাদের এ ব্যর্থতার জন্য তারা একা দায়ী নয়। তার পরিবার এবং সমাজও দায়ী।
এই বিশ্ব চরাচর সকলের মিলিত প্রয়াসেই সচল থাকে। মানুষ হিসেবে সমাজে সবারই গুরুত্ব রয়েছে- এমন চিন্তা ভাবনা হৃদয়ে লালন করাই শ্রেয়।উচু-নীচু, ধনী-গরীব, মেথর-ধনপতি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে আমরা নানা ধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছি বলেই এই পৃথিবীটা এখনও সচল। রিকশাওয়ালা বলে, মুচি বলে, নিম্নশ্রেণী বলে আমরা অনেক সময় তাঁদের সম্মান দিয়ে কথা বলিনা, নাক সিটকাই- যা কাম্য নয়। আল্লাহ যদি আমাদেরকে আজ তাদের জায়গায় রাখতেন- আমাদের কি এরূপ আচরণ পেতে ভাল লাগত? কে জানে হয়ত বা ভাল সুযোগ-সুবিধা পেলে ঐ মানুষটি আমাদের চেয়েও যোগ্যতাসম্পন্ন একজন মানুষ হতে পারতেন!
সরকারি চাকুরীজীবী আর বেসরকারি চাকুরীজীবী-একটি মায়ের দুটি সন্তান। এই দুটি শ্রেণীই যদি একটি দেশের সন্তান হয়ে থাকে তাহলে দুই শ্রেণীর চাকুরীজীবীদের মাঝে খুব বেশি বৈষম্য থাকা উচিত নয়। সরকারি চাকুরীজীবীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে- সেটি ভাল কথা। কিন্তু বেসরকারি চাকুরীজীবীদের দিকেও তো একটু খেয়াল রাখতে হবে? তাদেরকে যেন নিয়মের অতিরিক্ত শ্রম দিতে বাধ্য করা না হয়, একটু মতের অমিল হলেই যেন তাদের ছাঁটাই করা না হয়, চাকুরী শেষে তারাও যেন শান্তিতে শেষ জীবনটা অতিবাহিত করতে পারেন, তাদের প্রতি কোন অন্যায় হলে তারা যেন দ্রুত ন্যায় বিচার পান- সেদিকেও তো খেয়াল রাখা উচিত? তেলী মাথায় তেল দেওয়া থেকে শাসকদের বিরত থাকতে হবে। যাদের মাথায় একেবারেই তেল নেই- তাঁদের কথাও একটু ভাবুন।
অনেক বেসরকারি চাকুরীজীবীদের মামলা বিচারালয়ে বছরের পর বছরপড়ে থাকে। সময়মত তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু তাই বলে তাদেরজীবন তো আর থেমে থাকে না। মামলা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাদেরযে অসহায় এবং মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়- সে দুঃখগুলি নিয়ে কর্তা ব্যক্তিবর্গ কী একটুও ভাববেন না?
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com
মতামতের জন্য লেখক ব্যক্তিগত।