অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
আইন পেশা ( Legal Profession): বিচার প্রার্থী জনগণের আশা আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার কার্য পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন বিচার সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় অঙ্গ প্রতিষ্টানের মাধ্যমে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় সকল দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত, বিশেষ আদালত, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, বিচারকবৃন্দ আইনজীবীবৃন্দ, আইন অফিসার অর্থাৎ এটর্নি জেনারেল, পাবলিক প্রসিকিউটার (পিপি), সরকারী উকিল(জিপি), আদালতের রেজিস্টার প্রভৃতি ও আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রনে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যবৃন্দ। সুতরাং আইন পেশা আইন ব্যবস্থায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কারন তারা মামলাকারী এবং আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকেন। আইনজীবীদের ভাল অবস্থান, আইনবিষয়ে বুৎপত্তি ও যথেষ্ঠ জ্ঞান এবং বিভিন্ন বিষয়ে ভাল তথ্য সম্পন্ন জ্ঞান ব্যতীত আদালত যথেষ্ট দক্ষতার সাথে ন্যায়বিচার পরিচালনা করতে পারেনা। বিজ্ঞ বিচারকের দক্ষতা অবশ্য অনেকাংশে বিজ্ঞ আইনজীবীদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। তাই বলা হয়ে থাকে যে,শক্তিশালী আইন সম্প্রদায় (Bar) শক্তিশালী বিচারক সম্প্রদায় (Bench) উৎপন্ন করে”
বিভিন্ন রাষ্টে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেলেও বাংলাদেশে আইন পেশাজীবীদের মধ্যে কোন ভীন্নতা নেই। সকল আইন পেশাজীবী ব্যারিস্টার,এটর্নি আইনজীবী যে-ই হোকনা কেন বার কাউন্সিলের সনদ পাওয়ার পর সকলেই অ্যাডভোকেট বা আইনজীবী নামেই পরিচিত। তারা সকলেই একই আইনগত অবস্থান,মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করে থাকেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আদেশের অনুদ ২(ক) অ্যাডভোকেট এর সংগা প্রদান করেছে। যিনি Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972 এর অধীন Bar Council- এর Roll- এ অ্যাডভোকেট হিসেবে প্রবেশ করবে তাকেই অ্যাডভোকেট বলা হবে। এই আদেশর ১৯ অনুচ্ছেদ একজন অ্যাডভোকেটকে সমগ্র বাংলাদেশে আইনপেশা চর্চা করার অধিকার প্রদান করেছে এবং তিনি যে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে সক্রিয়ভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন।
উপমহাদেশে আইনপেশার ইতিবৃত্তঃ
বৃটিশ পূর্ব ভারতে আইন পেশাজীবীরা উকিল ও মোক্তার নামে পরিচিত ছিল। তারা আদালতের কতৃত্ব ও তত্বাবধানে আইন পেশা চর্চা করত এবং সেইসময় বার কাউন্সিল বা বার এসোসিয়েশন এর মতে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা ছিলনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে শাসন ক্ষমতায় আসার পরে এবং তারই ফলশ্রæতিতে উপমহাদেশে বৃটিশ আইনের প্রভাবে আইন পেশার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আইন পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় পৃথক হতে বাধ্য হতে বাধ্য হয়েছে। এর কারন মূলত দু’ধরনের বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন। প্রথমতঃ প্রেসিডেন্সি টাউনে এক ধরনের বিচার ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়তঃ মফস্বল এলাকায় অন্য ধরনের বিচার ব্যবস্থা। Charter 1726 এর অধীন Mayor’s Court চলাকালীন সময়ে আইন পেশাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিলনা। প্রেসিডেন্সি শহর কলকাতায় সুপ্রিম কোট প্রতিষ্ঠার পর ১৭৭৪ সালের ঈযধৎঃবৎ অনুসারে ইংলিশ ব্যারিস্টার এবং এটর্নিগণ সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রনে ভারতে আইনপেশার চর্চা করতে পারতেন। প্রেসিডেন্সি শহরে সুপ্রিমকোর্টে সরাসরি বৃটিশ আইনজীবীদের আইনপেশায় এক”ছত্র আধিপত্য ও অধিকার ছিল। একজন ভারতীয় আইনজীবীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আইনপেশা চর্চার কোন সুযোগ ছিলনা। ভারতীয় উপমহাদেশে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ আইন হল Legal Practitioner’s Act (Act 1 of 1846) যা শুধুমাত্র ভাকিলদের অবস্থান নয় ব্যারিস্টারের অবস্থানও নিযন্ত্রন করত।
ব্যারিস্টারগণ যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট ব্যতীত অন্য কোথাও আইন চর্চা করার অনুমতি পেতনা, এই আইনে কোম্পানীর আদালতে আইন চর্চা করার অধিকার প্রদান করে। সুতরাং এই আইন এটর্নি ও ব্যারিস্টারদের কোম্পানীর আদালতে আইন চর্চা করার সুযোগ দান করে। অবশ্য এ আইনে কোন ভারতীয় আইন পেশাজীবী সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশা চর্চা বা পরিচালনার অনুমতি প্রাপ্ত হয়নি। ভারতে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর ১৮৭৯ সালে আরেকটি Legal Practitioner’s Act পাশ করা হয় যাতে ঐ সময়ের আইন পেশা সংক্রান্ত সকল আইন সংকলন ও সংশোধন করার প্রচেষ্টা করা হয়। এই সময়ে আইনজীবীগণ ছয়টি ভাগে বিভক্ত ছিল ১) আইনজীবী, সলিসিটর,এবং হাইকোর্টের ভাকিল (ভোকিল) , প্লিডার, মোক্তার, এবং অধীনস্ত আদালতের রেভিনিউ অফিসার। উল্লেখ্য ভাকিল ও মোক্তারগন হচ্ছে ভারতীয় স্বদেশী আইনপেশাজীবী। ভাকিলের পূর্ণ অধিকার ছিল উচ্চতর আদালতে প্র্যাকটিস করার কিন্তু মোক্তারের সীমিত অধিকার ছিল অধীনস্ত আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার পরিচালনা করার। এই Legal Practitioner’s Act আইনজীবীদের ছয়টি বিভাগকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থার আওতায় আনে হাইকোর্টের এখতিয়াভূক্ত করার মাধ্যমে।
অবশ্য এই আইন এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পরিপূর্ণ বিধিবদ্ধ আইন ছিলনা,এই আইন নিয়ন্ত্রন করত অধীনস্ত আদালতের মোক্তারগণকে। অ্যাডভোকেট আইনজীবীদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য ছিলন। তারা নিয়ন্ত্রিত হত হাইকোর্টের বিভিন্ন এর মাধ্যমে। উল্লেখ্য ভাকিল ও মোক্তারগন হচ্ছেভারতীয় স্বদেশী আইনপেশাজীবী। ভাকিলের পূর্ণ অধিকার ছিল উ”চতর আদালতে প্র্যাকটিস করার কিন্তু মোক্তারের সীমিত অধিকার ছিল অধীনস্ত আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার পরিচালনা করার। যাহোক বিভিন্ন গ্রেডের আইন পেশাজীবীদের একত্রীকরনের লক্ষে এবং তাদের স্বায়ত্বশাসিত একটি ইধৎ গঠনের জন্য The Indian Bar Council Act,1926 পাশ করা হয়। এই আইন মামলাকারী, Pleader ও ব্যারিস্টারের মধ্যে পার্থক্য দূরিকরনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করে। অবশ্য আইনটি তখন সন্তোষজনক ফলাফল প্রদানে ব্যর্থ হয়। এর কারন আগের আইনজীবীদের নিয়োগ হাইকোর্টের উপরই ন্যাস্ত ছিল; বার কাউন্সিলের কাজ ছিল শুধুমাত্র উপদেষ্টামুলক। বার কাউন্সিলকে কোন স্বয়ত্বশাসিত মর্যাদা দেয়া হয়নি।
১৯৪৭ সালে ভরত ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর Legal Practitioner’s and Bar Council Act,1965 পাশ করা হয় এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল আইনপেশা সংক্রান্ত আইনগুলো সংযুক্ত ও সংশোধন করা এবং বার কাউন্সিলের সংবিধান প্রনয়ন করা। এই আইন প্রবর্তনের পূর্বে আইন পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রন ও নিয়মানুবর্তিতা আদালতের হাতে ন্যাস্ত ছিল। তখন বেঞ্চ ও বার পৃথক ছিলনা। এই আইনই প্রথম আইন পেশাকে স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনে। কিন্তু সকল আইনপেশাজীবীকে একত্রীকরণে ব্যর্থ হয় কারণ মোক্তারগণ এই আইনের আওতার বাইরে ছিল। মামলাকারী চষবধফবৎ ও মোক্তার অধীনস্ত আদালতে কাজ করত এবং ঐ আদালত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। অপরপক্ষে অ্যাডভোকেট ও ব্যারিস্টারগণ হাইকোর্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর Legal Practitioner’s and Bar Council Act,1965 বাতিল করে Bangladesh Legal Practitioner’s and Bar Council Act,1972 পাশ করা হয়। এই অধ্যাদেশ একটি কাউন্সিলের জন্ম দেয় যা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নামে পরিচিত। ২৭(১ক) অনুচ্ছেদ আইন পেশাজীবীদের সত্যিকার অর্থে একত্রিকরনের ব্যব¯’া করেছে এবং বিধান করেছে যে যিনি অন্ততঃ সাত বছর মোক্তার ছিলেন তিনি এই আদেশের অন্যান্য নিয়ম অনুসারে আইনজীবী হিসাবে গন্য হবেন। পূর্বে ভীন্নতা থাকলেও এখন একটি মাত্র স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অধীনে মাত্র একটি শ্রেণীতে সকল আইন চর্চাকারী অ্যাডভোকেট নামে পরিচিত হবে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠান হলো আজকের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।
একত্রিকরনের মাঝেও কিছু শ্রেনীবিন্যাসঃ যদিও উপরে উল্লেখিত আইন অনুসারে বাংলাদেশ একটিমাত্র শ্রেণিতে অ্যাডভোকেটগণ আইনপেশা পরিচালনা করে থাকে তবু অ্যাডভোকেটদের তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করা যায় প্রথম গ্রুপ হচ্ছে যারা নিম্ন আদালতে আইনপেশা চর্চা করেন। এই সকল আইনজীবীগণ কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে না গেলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা পরিচালনা করিতে পারেন না। দ্বিতীয় গ্রæপের মধ্যে পড়বে ঐ সকল আইনজীবীগন যারা সুপ্রিমকোর্টে মামলা পরিচালনা করার অধিকার অর্জন করেছে এ সকল অ্যাডভোকেটগণ অধীনস্ত আদালতেও আইন চর্চা করতে পারে। তৃতীয় গ্রুপ হলো সেই সকল অ্যাডভোকেটগন যাদের সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার অধিকার আছে। তারা Advocates-on-Record নামে পরিচিত। Advocates-on-Record এ নিয়োগ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) বিধান,১৯৮৮ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী, জজকোর্ট মেহেরপুর E-mail: advmizanur98@gmail.com.