রায়হান কাওসার
এই পৃথিবীতে একসময় ছিল পেশী শক্তির রাজত্ব। পেশিশক্তিতে যারা এগিয়ে থাকত, তারাই টিকে থাকত এই পৃথিবীতে। যারা দুর্বল তাদের ভক্ষণ করা হতো নতুবা শক্তিশালী জীবদের সেবাকরারজন্য গোলাম করে রাখা হতো। অবশ্য, মানুষও একসময় গোলাম ছিল। বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৮৬৪ সালেও আমেরিকাতে দাস প্রথা ছিল। আদিমকাল থেকেই টিকে থাকার তাগিদে মানবকুল সংঘবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করত; পরস্পরকে সহায়তা করত। যা কিছু শিকার করত ,সেগুলি নিজেদের মধ্য বন্টন বা ভাগাভাগি করে খেত। তখন থেকেই মূলতমানবতার নীতি তথা নৈতিকতার ধারনার সূত্রপাত হয়।
পরবর্তিতে মানুষ যখন আর ও বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা করল তখন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আরও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচলিত মানবতা ও নৈতিকতার নীতিকে মানব সমাজ আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করল। বলা যেতে পারে, মানুষের কোন নির্দিষ্ট জীবনাচরণ আইনে পরিণত হওয়ার আগে সেটি একটি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যের পছন্দনীয় নীতিতে পরিণত হয়।তারপর, সেই নীতিকেই আইন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আসলে, আইনের জন্ম হয়েছে নৈতিকতা থেকেই। পৃথিবী আধুনিক হওয়ার সাথে বিচার ব্যবস্থায় ও এসেছে অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে নৈতিকতা ও যৌক্তিকতার নানা নীতিকে এখন অনুসরণ করা হয় সারা বিশ্বের বিচার ব্যবস্থা গুলোতে- যেটি সত্যই প্রশংসনীয়।
Principles of Natural Justice- এরদুটি প্রধানশর্ত হলো “No one can be a judge of his own cause”. অর্থাৎ কোন ব্যক্তির নিজ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেই বিচারক হতে পারবেন না।এবং “No one should be condemned unheard”অর্থাৎকাউকে ভালভাবে না শুনে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনের অধীনে যখন সরকারের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিচার করতে যান, তাঁর পক্ষেউক্ত নীতি দুটি পুরোপুরি মেনে বিচার করা সম্ভব হয়না।
প্রথম শর্তের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা যখন তার প্রশাসনিক দায়িত্বাধীনএলাকায় কোন অনিয়মের বিচার করতে যান, প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেই সেই অপরাধের বাদী বা Complainant হিসেবে সেখানে উপস্থিত হন এবং সেই অপরাধের বিচার করেন। দেখা যাচ্ছে, তিনি একই সাথে অভিযোগকারী এবং বিচারক হচ্ছেন যেটিPrinciples of Natural Justice- এর পরিপন্থী। একজন ব্যক্তি একই সাথে অভিযোগকারী এবং বিচারক হলে সেই বিচার পক্ষপাতদুষ্টু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।
Principles of Natural Justice- এর দ্বিতীয় শর্ত হলো ভালভাবে না শুনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। মোবাইল কোর্ট বিচার ব্যবস্থার আওতায়, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাৎক্ষনাৎ। সাধারণ বিচারিক নীতি অনুযায়ী, যে বিচারক বিচার করবেন, তিনি উভয়পক্ষকে ভালভাবে শুনে তারপর রায় প্রদান করবেন। কিন্তু মোবাইল কোর্টের আওতায় বিচার হলে, প্রশাসনিক অফিসার এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় কোন পক্ষ থাকে না। প্রশাসনিক অফিসার একইসাথে অভিযোগকারী ও বিচারক হিসেবে অভিযুক্তকে শুনে ঘটনাস্থলেইতাৎক্ষনাৎ রায় প্রদান করে থাকেন। এক্ষেত্রে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শোনা হলেও অভিযোগকারীকে শোনার জন্য তৃতীয় নিরপেক্ষ কোন কর্তৃপক্ষথাকে না। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, Principles of Natural Justice – এর দ্বিতীয় নীতিটাও পুরোপুরি অনুসরণ করাহচ্ছে না।
মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচারের ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সময় ও সুযোগকম থাকে। অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ায় সুযোগ পান না। অনেক সময় যথাযথ সাক্ষীরও অভাব থাকে। কিন্তু তা সত্বেও সাজার পরিমাণ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে এই আইনের আওতায় এবং মোটা টাকার আর্থিক জরিমানাও গুণতে হয় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। প্রশাসনিক অফিসারের সাথে যদি পূর্বে কোন খারাপ অভীজ্ঞতা থেকে থাকে, তাহলেসেটি বিচারের সময় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাও থাকেবেশ যেটি কুড়িগ্রামের ডিসি’র বিচার প্রক্রিয়ায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনায় কুড়িগ্রামের ডিসি গভীর রাতে আরিফুল ইসলাম নামক একজন সাংবাদিকের বিচার করতে গিয়েছিলেন দলবলসহ। মারধর করেজোর পূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে এক বছরের সাজা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন সেই অভিযুক্তকে। এই বিচার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষ কোন সাক্ষী ছিল না। প্রকারান্তরে অভিযোগকারী ও বিচারক ছিলেন ডিসি নিজেই। তিনি অতীতের ঘটনায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে অভিযুক্তকে সাজা দিয়েছেন- এমনটিও প্রকাশ পায়। এই ঘটনায় অতীতে অনুরূপ অঘটন ঘটানো আরডিসি নাজিম উদ্দিনও জড়িত ছিলেন বলে পত্রিকায় আসে।
বিচারিক ক্ষমতা হাতে পেয়ে অনেক সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ সেটি অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করে বসেন-এমন ঘটনাও ঘটে। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার এসি (ল্যান্ড) তার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দু’জন অসহায় বৃদ্ধকে কানে ধরিয়ে উঠ-বোস করান এবং সেই দৃশ্যের ছবিতোলেন তার নিজ মোবাইল ফোনে। এই ঘটনাটিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসে। সম্প্রতি,চাল চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পেকুয়া উপজেলার ইউএনও কে প্রত্যাহার করা হয়েছে- মর্মে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত অনেক ঘটনার সবগুলোই পত্রিকা-টেলিভিশনে আসেনা। দু’একটি ঘটনা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। নিভৃতে-অগোচরে অনেক মানুষই হয়রানির শিকার হন। পারিপার্শ্বিক নানা পরিস্থিতির কারণে সেটি প্রকাশ করতে পারেন না।
একই ব্যক্তি প্রশাসক এবং বিচারক হওয়া অনিরাপদ। প্রশাসনিক কাজ করতে গিয়ে যদি একজন অফিসার কোন ব্যক্তির প্রতি রুষ্ট হন এবংতিনি ঐ ব্যক্তির বিচার করতে যান, সেই বিচারে নির্বাহীঅফিসার কতটুকু নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে সক্ষম হবেন- সেব্যাপারে সত্যই সন্দেহ রয়েছে। প্রতিটি অফিসারই রক্ত-মাংসের মানুষ, ফেরেস্থা নন। দৈনন্দিন জীবনের নানা কারণে তারা পক্ষপাতদুষ্ট হোন না- এ কথা বলা সঠিক হবে না।
ক্ষমতার ভারসাম্য (চেক এ্যান্ড ব্যালান্স) রক্ষার জন্য হলেও একই ব্যক্তিকে একসাথে প্রশাসনিক ও বিচারিক- দুই ধরনের ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। তাই, মোবাইল কোর্ট আইনে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ করা যেতে পারে যাদের আইন বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা ও বাস্তব বিচারিক অভীজ্ঞতা রয়েছে।
একজন প্রশাসনিক অফিসারকে যদি অভিযোগকারী এবং একজন আইন অমান্যকারীকে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়,তাহলে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মাঝামাঝি আরেকজন ব্যক্তি থাকবেন- যিনি হবেন একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বিচারকার্য পরিচালনা করার ফলে তিনিএকজন প্রশাসনিক অফিসার অপেক্ষা অধিক নিরপেক্ষ ও দক্ষতার সাথে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন আশা করা করা যায়।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com
মতামত লেখকরে ব্যক্তিগত