সব
facebook apsnews24.com
মেধা পাচার (Brain Drain) এবং বাংলাদেশ - APSNews24.Com

মেধা পাচার (Brain Drain) এবং বাংলাদেশ

মেধা পাচার (Brain Drain) এবং বাংলাদেশ

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব খান

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিট নিয়ে ক’দিন থেকেই কিছুটা উত্তাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বলছে সরকার তাদের যথাযথ সহযোগিতা করছে না, আবার ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবী করছে। এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ফলে জনমনেও বেশ বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অনেকে হয়ত এর মাঝে রাজনীতিকরণের আভাসও দেখছেন। আশার কথা হল সেচ্ছাসেবী সংগঠন “সুচিন্তা ফাউন্ডেশন” সিআরও বা তৃতীয় পক্ষ দ্বারা এই কিটের কার্যকারীতা পরীক্ষার জন্য আর্থিক বিষয়ে এগিয়ে আসেছে। আমরা আশা করবো এই বৈশ্বিক সংকটে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট হবে আশাজাগানিয়া।

কিট নিয়ে পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক ধরনের যুক্তি আমরা দেখেছি এবং সংবাদপত্রেও পড়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সব থেকে কঠোর এবং প্রায় আগ্রাসী মতামতও চোখে পরেছে। তবে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না জল ঘোলা হয়েছে এ কারণে যে, অনেক মানুষ কিট বা করোনা টেস্ট নিয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকলেও কথা বলতে ছাড়েনি।

আমরা বলতে চাই প্রতিটা জিনিসের বা সৃষ্টিকর্মের ভাল এবং মন্দ দিক থাকবেই। এটাও মনে রাখা জরুরী যে, বিজ্ঞান কখনই পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদ বা বানর থেকে মানুষ রুপান্তরের বিষয় যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে আবার এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে অনেক বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বলা বাহুল্য বাংলাদেশে কিট নিয়ে যে ধরনের ঘটনা ঘটলো তা সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত।  এর ফলে ভবিষ্যতে গবেষনার দ্বার সংকোচিত হল কিনা সে প্রশ্ন তোলাই যায়।

দুই.

আমরা Brain Drain  বা মেধা পাচার শব্দের সাথে সবাই মোটামুটি পরিচিত। এর অর্থ হল কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন কিংবা শিক্ষিত মেধাবীদের বিরাট অংশের অভিবাসন অথবা অন্যদেশে গমন।  সাধারণত যুদ্ধ, সুযোগ সুবিধার অভাব,ভাল জীবনযাপনের ব্যবস্থা না থাকা, অপ্রতুল বেতন ভাতা, প্রযুক্তিগত সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবন যাপনের ঝুঁকি এড়াতে মানুষ নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়। ফলশ্রুতিতে একটি দেশ তার সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, দক্ষ ও যোগ্য নাগরিককে হারায়।
মোটামুটি সকল দেশেই এই সংকট রয়েছে। তবে উন্নয়নশীল বা স্বল্পউন্নত দেশগুলোতে এই সংকট আরও তীব্র।

International Organisation for Migration  (IOM) এর ২০১৯ রিপোর্ট  অনুযায়ী বিশ্বব্যাপি এ বছর অধিবাসীর সংখ্যা পৌঁছেছে ২৭২ মিলিয়নে যা মোট জনসংখ্যার ৩.৫ ভাগ। এর মধ্যে উপরোপে ৮২ মিলিয়ন,দক্ষিণ আমেরিকায় ৫৯ মিলিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াতে ৪৯ মিলিয়ন মানুষ তাদের নিজ দেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দেশে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের দুই তৃতীয়াংশ বসবাস করছে মাত্র ২০ টি দেশে। এই তালিকায় প্রথমে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় ৫১ মিলিয়ন ভিনদেশি মানুষ পাড়ি জমিয়েছে সেখানে যা মোট অভিবাসীদের ১৯ শতাংশ। জার্মানি এবং
সৌদি আরব যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থনে রয়েছে প্রত্যেকে প্রায় 13 মিলিয়ন। তারপরের অবস্থানে  রাশিয়া (১২ মিলিয়ন) এবং যুক্তরাজ্য (১০ মিলিয়ন)।

IOM এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে যেসব দেশ থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে তার মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ভারত (১৭.৫ মিলিয়ন)। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশী বসবাস করছে বিদেশে।

আমাদের আয়ের অন্যতম বড় একটা অংশ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে  বিদেশে বসবাসকারীদের পাঠানো রেমিটেন্স ব্যাপক অবদান রাখছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ দশটি রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশের তালিকায় অবস্থান করে নিয়েছিল।

তিন.

প্রতি বছর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে  বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। UNESCO ‘র পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে ২০১৭ সালে ৬০,৩৯০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে।

২০১৪ সালে UNESCO এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে ছয় বছরে প্রায় ১৯২ বিলিয়ন টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। এটা লক্ষনীয় যে, অর্থের ক্ষতির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে মেধার পাচার। এটি একটি বড় জাতীয় সমস্যা।
আমরা বলতে চাই, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়াটা দোষের নয়, তবে যে হারে ছাত্রছাত্রী বিদেশে যাচ্ছে তার তুলনায় দেশে ফেরার হার খুব কম।

প্রতিবছর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে বিদেশমুখী হলেও অনেকেই আর দেশে ফিরছেন না।

উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেড়ে নিচ্ছে, তাদের আকর্ষণীয় বৃত্তি দিয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ যেমন করে দেয় তেমনি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করার পরে তারা আকর্ষণীয় কাজের ব্যবস্থা করে দেয়, ফলে অনেকেই আর দেশে ফিরে আসে না। ফলস্রুতিতে উন্নত দেশগুলো প্রতিভা নিয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর  তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি পিছনেই থেকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী হবার পেছনে নানা বিধ কারণ আছে। যেমনঃ মান সম্মত শিক্ষার অভাব, অপ্রতুল গবেষনা সুযোগ,শিক্ষা খাতে দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, চাকুরীর অনিশ্চয়তা, জীবনমানের ধরন, শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানাবিধ সামাজিকতা এবং অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত।

উচ্চ শিক্ষার জন্য এখানে স্ট্যান্ডার্ড পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি। দেশের সরকারী বা বেসরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা এবং স্বজনপ্রীতি চোখে পরার মত।

শিক্ষার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি, যোগ্য শিক্ষকের  অভাবের মত বিষয়গুলো অবশ্যই উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গত এক দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় যথেষ্ট সাফল্য এসেছে। তবে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে অশান্তি ও রাজনৈতিক কলহ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সুতরাং যারা সামর্থ্য রাখে তারা তাদের বাচ্চাদের মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠায়।
যারা উন্নত দেশে মূল্যবান ডিগ্রি অর্জন করেন তারা সেদেশেই স্বপ্নের চাকরীটি গ্রহণ করলে দেশে ফিরে আসতে চান না, কারণ দেশে এরকম কোনও গ্যারান্টি নেই।

সব চেয়ে বড় সমস্যা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষনার সুযোগ খুবই কম। প্রতিবছর শিক্ষাখাতে যে বাজেট দেয়া হয় তা অপ্রতুল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। যা জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো এর হিসাব বলছে, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ তার জিডিপির যে অংশ ব্যয় করছে, তা দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সরকারি এই সংস্থাটির ২০১৬-১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারত ৩.০৮ শতাংশ, পাকিস্তান ২.৭৬ শতাংশ, আফগানিস্তান ৩.৯৩ শতাংশ, মালদ্বীপ ৪.২৫ শতাংশ, নেপাল ৫.১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২.৮১ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, সে বছর বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছিল মাত্র জিডিপির ১.৫৪ শতাংশ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা বিদেশ থেকে ফিরছেন না দোষ কি শুধু তাদের কাঁধে যায় কিনা। বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের যোগ্যতা অনুসারে কি আমরা কাজের ব্যবস্থা করতে পেরেছি? বা তাদের নিয়ে কোন কর্মপরিকল্পনা করেছি?

প্রায়শই দেখা যায় বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বড় অংকের বেতন নিয়ে কাজ করছেন। আমাদের সব থেকে বড় কর্মক্ষেত্র হল পোষাক খাত। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুসারে, বিদেশিরা আমাদের দেশে ২৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় নিযুক্ত হয়। দক্ষ জনশক্তির অভাবে তথ্য প্রযুক্তি, ট্যানারি, তৈরি পোশাক, পর্যটন, চা-শিল্প, নির্মাণ, এবং ভারী শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিদেশী শ্রমিকদের এনে কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এতে করে আমাদের দেশের মানুষরা কাজের সুযোগ হারায়।

চার.

ইউরোপ এবং আমেরিকা চালাকি করে পুরো বিশ্ব থেকে মেধা সংগ্রহ করছে। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় আমেরিকান নাগরিকের শতাংশের হার ৩০ শতাংশেরও কম। তারা পুরো বিশ্ব থেকে মেধাবী মানুষকে সেখানে গ্রহণ করছে। এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনার একটি অংশ। যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মত কাজ করছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার বিদেশী ডলার উপার্জন করছে। আর আমরা হারাচ্ছি জাতীর মেধাবী সন্তানদের মেধা এবং অর্থ দুটোই।

প্রতিটি খাত এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষার জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় পরিকল্পনা অপরিহার্য। সেই সাথে দরকার সুষ্ঠু পরিবেশ ও মান সম্মত শিক্ষা, শিক্ষা ক্ষেত্রে সব রকম দুর্নীতি এবং বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়াতে হবে গবেষনার সুযোগ। পাশাপাশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে চাহিদা অনুসারে। মেধাবীদের প্রত্যাশিত চাকরি ও মানসম্পন্ন জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকে জোর দিতে হবে।

আমরা চাই সরকার সেদিকে মনোনিবেশ করবে এবং দেশের মেধা পাচর বা Brain Drain রোধ করে দেশের মেধা দেশেই কাজে লাগিয়ে উন্নতদেশ  হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো, এমনটাই প্রত্যাশা।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব খান।
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
email: ghalibhit@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj