রায়হান কাওসার
মাঝে মাঝে পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরতৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের বলতে শুনি, “যারা আমাদেরকে ভোট দেননি তারাও এই সুবিধা পাবেন”, অথবা, “সরকারি সুযোগ-সুবিধা যেন প্রকৃত ভুক্তভোগী বা অভাবীদের নিকট পৌছায়”, কিংবা,রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা যেন দলীয় বিবেচনায় বন্টন করা না হয়” ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্টনের ক্ষেত্রে অনেক সময়মাঠ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না বলে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মাঝে মাঝে এরূপ নির্দেশনা দিয়ে থাকেনযাতে দরিদ্র ও অসহায় নাগরিকরা তাদের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণনাগরিক অধিকার ও সুবিধাসমূহ থেকে বঞ্চিত না হন।
সাধারণত, দেশের সকল নাগরিকই সাংবিধানিকভাবে সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী- সে যে দলকেই ভোট প্রদান করুক না কেন। একজন নাগরিকের অন্যান্য অধিকারের মত ভোট প্রদান করাও একটি অধিকার। সে কোন দলকে ভোট দিবে- সেটি তার একটি গোপনীয় ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে কারণেই গোপন ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কোন নাগরিক কোন দলকে ভোট দিলেন সেটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় অনেকবেশি এবং জানাজানি হয়। ফলেএকটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ করার কারণে অনেক সময় একজন নাগরিককে তাঁর মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত কিংবা বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে অনেক অনুচ্ছেদ রয়েছে (১০, ১১, ১৪, ১৫, ১৯, ২৭, ২৮)যেগুলি নাগরিকদের মধ্যে বিরাজমান নানারূপ বৈষম্য দুর করে সমতা প্রতিষ্ঠা, সম্পদেরসুষম এবং ন্যায়ানুগ বন্টনের কথা বলেছেবার বার। কিন্তু এখনও আমরা উক্ত সাংবিধানিক নির্দেশনাগুলো বাস্তবক্ষেত্রে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি।
কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলকে একজন নাগরিক ভোট দিয়েছেন কিংবা দেননি, বিধায় একটি রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিনি একটু এগিয়ে কিংবা একটু পিছিয়ে থাকবেন- এমন কোন নিয়ম নেই। একজন নাগরিক রাষ্ট্রীয় কোন সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন কি পাবেন না- সেটি তার প্রয়োজনের তীব্রতা,আর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে নির্ধারিত হতে হবে- রাজনৈতিক বিবেচনার মাধ্যমে নয়।
গণতান্ত্রিক দেশে অন্যান্য অধিকারের মত ভোট দেওয়াও একটি অধিকার। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭, ১১ এবং ১২২ এ একজন নাগরিকের ভোটাধিকার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই হবে- এরূপ কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তবে ভোট দেওয়া একজন নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। নির্বাচনের সময় একজন নাগরিক তাঁর ইচ্ছামত যে কোন দলকে ভোট দিতে পারেন কিংবা ভোট প্রদান থেকে বিরতও থাকতে পারেন।
একজন নাগরিক ভোটাধিকারের মাধ্যমে তার পছন্দের সেবক নির্বাচিত করবেন- এটাই ভোট প্রদানের মূলউদ্দেশ্য। তিনি কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ভোট প্রদান করলেওএই রাষ্ট্রের নাগরিক, না প্রদান করলেও এই রাষ্ট্রের নাগরিক কিংবা ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকলেও তিনি অন্যান্যদের মত এই রাষ্ট্রেরই নাগরিক এবং আইন ও নৈতিকতার নীরিখে সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী।তাই কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়া-না-দেওয়া কিংবা ভোট প্রদানে বিরত থাকার কারণে একজন নাগরিকের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে কোনরূপ তারতম্য ঘটানো সম্ভব নয়। সে কারণেই একজন নাগরিক কাকে ভোট দিলেন বা না দিলেন কিংবা ভোট নষ্ট করলেন- বিষয়গুলি পুরোপুরি অপ্রকাশিত রাখার জন্যগোপন ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোট গ্রহণকরা হয় যাতে ভোট পরবর্তী সময়ে কোন নাগরিক কোনরূপ বৈষম্যের শিকার না হন।
এই মহাবিশ্বে কোন প্রাণীই একা একাটিকে থাকতে পারে না। সে কারণে আদিমকাল থেকেইমানুষ একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে এবংএকে একে গঠন করেছে পরিবার, পরিবার থেকে ছোট ছোট গোত্র এবং গোত্র থেকে রাষ্ট্র। তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হলো- টিকে থাকা, জীবনকে আরেকটু সহজ করা,জীবনের চলতি পথের সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া।
একটি পরিবারের কোন সদস্য কোন সমস্যা বা বিপদে পড়লে যেমন পরিবারের অন্য সদস্যরাও সম্মিলিতভাবে সেই বিপদকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে, সমাজ এবং রাষ্ট্রও তেমনি বৃহৎ অর্থে একটি পরিবার। একটি পরিবারে যেমন বিপদ-আপদ আসে তেমনি একটি রাষ্ট্রেরও বিপদ-আপদ আসতে পারে। যেমন- বহিঃশত্রুর আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা কিংবা মহামারিসহ নানাবিধ বিপদ।
একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হলো সেই পরিবারের সদস্য। রাষ্ট্রীয় তহবিলে যে টাকাগুলো জমা হয়, সেখানে সকল নাগরিকেরই অবদান থাকে। একজন ভিক্ষুকও নিজের অজান্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে থাকে। বাজারে গিয়ে ভিক্ষুক যে সকল পণ্য কিনে, তার অনেকগুলোর মধ্যে সরকার ভ্যাট বসিয়ে রাখে। পণ্যটি কেনামাত্রই সে অবচেতন মনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে আসে।
নাগরিক জীবনে প্রতিটি ব্যক্তিই কোন না কোন পেশায় জড়িত থাকে। রাষ্ট্রেকে সেবা প্রদান করে। সে কারণেই রাষ্ট্র নামক এই বৃহৎ পরিবারটি প্রতিনিয়ত চলমান রয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্র একটি পরিবার এবং সকল নাগরিকই রাষ্ট্রকে সচল রাখার জন্য কোন না কোন ভাবে অবদান রেখে চলেছে। তাই আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকই সমান।
একটি রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়া ও সর্বদা সচল রাখার জন্য কিছু লোকের দরকার হয় যাদেরকে একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের করে আনা হয়। সে কারণেই সৃষ্টি হয়েছে ভোটাভুটি পদ্ধতির; নতুবা ভোটাভুটির কোন দরকার ছিল না। তাই শুধুমাত্র এই ভোটাভুটির কারণে রাষ্ট্রেরএকজন সদস্যকে কষ্ট পেতে হবে, বৈষম্যের শিকার হতে হবে- সেটি কাম্য নয়। ভোটাধিকারের চেয়ে নাগরিক অধিকার একটি বড় প্রত্যয়- এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যেমন নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকে, তেমনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যেও নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকবে- সেটিকে একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ভোটাভুটিতে সামান্য দ্বিমত পোষণ করেছেন বলে একজন নাগরিক তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন কিংবা বৈষম্যের শিকার হবেন- সেটি প্রত্যাশিত নয়।একটি পরিবারকে ভালভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হয় একজন কর্তাকে। কিন্তু একজন কর্তা নির্বাচন করতে গিয়ে যদি পরিবারের সদস্যদের মধ্য তুমুল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবংএকজন সদস্য যদি তার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার সমূহই হারাতে বসেন- তাহলে সেই নির্বাচন বা ভোটাভুটি দিয়ে কী হবে! সেকারণেই বোধ করি ভোট দেওয়াকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
রাষ্ট্রের চোখে সকল নাগরিকই সমান। মা যেমন তাঁর সন্তানদের সমান চোখে দেখেন। রাষ্ট্রকেও তেমনি সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখতে হবে। যার যেরকম প্রয়োজন এবং পরিস্থিতি, তাকে সে অনুপাতে সহায়তা করতে হবে। এটি একজন নাগরিকের একইসাথে মানবিক এবং সাংবিধানিক অধিকার- যা তৃণমূল নেতৃবৃন্দদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
দিনশেষে সব মানুষই স্বার্থপর। একজন নেতাও একজন মানুষ। সব সময় সকল নেতাএকেবারে উচ্চ আদর্শের হবেন- সেটি আশা করা ঠিক নয়। তাই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্টনের সময় একাধিক কর্তৃপক্ষকে সংযুক্ত রাখা খুব দরকার যাতে করে গুরুত্বপূর্ণ সকল নাগরিক অধিকারের বিষয়েকোন একক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন এবং ভুল না করেন।যার কারণে রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত নাগরিককেযেন তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে না হয়, মানবেতর জীবন যাপন করতে না হয় কিংবা সন্তানদের ভালভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হতে না হয়।
যারা একটি বৃহৎ পরিবারকে নেতৃত্ব দেবেন তাদের সত্যিকার অর্থেই অনেক বিবেকবান ও নিরপেক্ষ মন-মানসিকতার হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নয় যাকে তাকে টাকার বিনিময়ে কিংবা পারিবারিক পরিচয়ে নমিনেশন দিয়েদেওয়া। টাকা এবংপারিবারিকপরিচয় একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য প্রধানতম যোগ্যতা হতে পারেনা। শিক্ষাগত যোগ্যতা, নৈতিকজ্ঞান, জনগণের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলি সবার আগে বিবেচনা করতে হবে যা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত।
রাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ ডিপার্টমেন্টে যেসব কর্মকর্তাগণ চাকুরী করেন তাদেরকে নানা রকম প্রফেশনাল ও মোটিভেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হয় যাতে তাঁরা তাদের দায়িত্বগুলো সুচারুভাবে পালন করতে পারেন। পক্ষান্তরে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দগণ এ সকল আমলাদের চেয়ে মনে হয় না কম জন-গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাহলে রাজনৈতিক নেতাদের জন্যও প্রফেশনাল ও মোটিভেশনাল ট্রেনিঙয়ের ব্যবস্থা কেন করা হবে না? নেতৃবৃন্দের মধ্যে নৈতিকতা, সহনশীলতা ও পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জ্ঞানকে জাগ্রত করতে পারলেই একটি দেশে দ্রুত সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্টা করা সম্ভব। তাহলেই কেবল,একজন নাগরিক তাঁর মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে মুক্তি পাবেন।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সাবেক শিক্ষার্থী অঅইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামতের জন্য লেখকই দায়ী থাকিবেন।