মোঃ আজিজুর রহমান দুলু
নিম্নোক্ত দুটি প্রশ্নের উত্তর আমরা যদি খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে আমরা শিরোনামের প্রশ্নের উত্তরে পৌঁছাতে পারি। প্রশ্ন দুইটি হলোঃ ১। সংবিধান স্থগিত ছাড়া সংবিধানের অধীন সৃষ্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সাধারণ ছুটির আওতায় তার সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করতে পারে কিনা? এবং ২ । যে কার্যকর সংবিধানের অধীন নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের একটি অংশ অর্থাৎ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি এর একাধিক জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট যখন সাধারণ ছুটির আওতায় থেকেও জরুরী কার্যক্রম এবং জরুরী মামলার কার্যক্রম চালাতে পারেন সেই সংবিধানের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট জনগণের মৌলিক অধিকার বলবৎ এর জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস,১৯৭৩ এর Chpater XIA এর ১০ নম্বর রুল এবং 53 DLR (2001) 414 নজির এর পদ্ধতিতে গুরুতর প্রকৃতির কার্যক্রম চালাতে পারে কিনা?
বর্তমানে দেশব্যাপী চলমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ সংক্রমণ পরিস্থিতি কে আমরা যদি দেশের ভিতরে চলমান যুদ্ধ কিংবা সারা বিশ্বে চলমান বিশ্বযুদ্ধের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে সেই অবস্থাতেও সাংবিধানিকভাবে আমাদের বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তার সকল কার্যক্রম গত এক মাসের মত বন্ধ করতে পারে কিনা? ইতিহাস কি বলে তা একটু জানা দরকার। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার পর হইতে ১৯৭৪ সালে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল এর সময়কাল ছিল ১৯৭৪ সালের মার্চ মাস হতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো ভয়াবহ সেই দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন কিনা? সহজ উত্তর হলো হ্যাঁ। এখন দেখা দরকার মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার উচ্চ আদালত কিংবা যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগ কার্যক্রম চালিয়েছিল কিনা? উত্তর হলো হ্যাঁ।
জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎ করে ১৯৪১ সালের ৭ ই ডিসেম্বর সকাল আটটার আগে আমেরিকার পার্ল হারবার আক্রমণ করেন। পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইহা আমরা সবাই জানি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে যে সকল ল্যান্ডমার্ক মামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুনানি হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো Korematsu v United States 323 US 214(1944) যে মামলায় Korematsu জাপানিজ আমেরিকান নাগরিক তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এর ৯০৬৬ নম্বর নির্বাহী আদেশ কে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। উক্ত মামলার শুনানি হয়েছিল এবং রায়ও হয়ে গিয়েছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন সময়ে। একইভাবে যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগের ইতিহাসে হ্যারি ডবকিন নামক একজন ব্যক্তি কে তার স্ত্রী রাচেল ডবকিনকে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমান বাহিনী কর্তৃক যুক্তরাজ্যে আক্রমণের সময়) তার স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যার জন্য বিচার শেষ করে ১৯৪৩ সালের ৭ই জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলো থেকে পরিষ্কার যে, দেশে বর্তমানে চলমান করনা যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ খারাপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এবং যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে ছিলেন। এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এবং যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংবিধান কার্যকর থাকার সময়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যদি তার কার্যক্রম গত এক মাসের মতো বন্ধ রাখেন আগামীতে যে সময় ধরে সেই সময়ে সংবিধানে উল্লেখিত নাগরিকদের এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অধিকার সরকার কর্তৃক লঙ্ঘিত হলে তার প্রতিকার বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপ সঠিক পদক্ষেপ কিনা তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। আইনের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে ইহা আমার নিকট প্রতীয়মান হয় যে এ ধরনের পদক্ষেপ সঠিক পদক্ষেপ নয়।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে, অনেকের মতে ভার্চুয়াল আদালত শুরু করা যেতে পারে। আসলে ভার্চুয়াল আদালত বলে আমাদের সংবিধানে কোনো আদালত নেই। আমাদের উচ্চ আদালতের কার্যক্রম অনলাইন বা ভার্চুয়ালি করা যেতে পারে। কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস ১৯৭৩ এ উচ্চ আদালতের কার্যক্রম অনলাইন বা ভার্চুয়ালি করার ব্যাপারে কোন বিধান সরাসরি না থাকলেও কর্তৃপক্ষ উক্ত রুলস,১৯৭৩ কে সংশোধন করে করতে পারেন। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস,১৯৭৩ এর Chapter XIA এর ১০ নম্বর রুল এবং 53 DLR (2001) 414 নজির এর আলোকে এবং পদ্ধতিতে যে সুযোগ প্রদান করা আছে উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। উপরোক্ত ভিত্তিদ্বয়ের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা এইজন্য প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের সমস্ত জায়গায় ভার্চুয়াল বা অনলাইন পদ্ধতিতে আদালতের কার্যক্রম সমভাবে এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্পাদন করার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা বাংলাদেশের সকল জেলায় ঢাকা শহরের মত ইন্টার্নেট ফেসিলিটি সমান নয়।
আবার যে কোন কারনে ঢাকাসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান ইন্টার্নেট ফেসিলিটি যে কোন সময়ের জন্য বিঘ্নিত হতে পারে বা বন্ধ থাকতে পারে। আবার সকল আইনজীবী ভার্চুয়াল বা অনলাইন পদ্ধতিতে রাতারাতি কার্যক্রম সম্পাদন করার ক্ষেত্রে সমভাবে সক্ষম নাও হতে পারেন। এইজন্য ইমেইলের মাধ্যমে, পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অথবা অন্য কোন মাধ্যমে যেমন চিঠি প্রেরণ করতে পারবেন বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক তেমনি একজন আইনজীবীও একজন নাগরিকের ন্যায় তার লিখিত আবেদন উপরোক্ত পদ্ধতি যেকোনো একটি ব্যবহার করে প্রেরন করিতে পারিবেন।
উপরোক্ত কারণে সংবিধান স্থগিত ছাড়া সংবিধানের অধীন সৃষ্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সাধারণ ছুটির আওতায় তার সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করার পদক্ষেপ যথাযথ নয়।
মোঃ আজিজুর রহমান দুলু, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট,E-mail: azizurrahmandulu@gmail.com
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত এজন্য তিনি নিজেই দায়বদ্ধ থাকিবেন।