মোঃ আজিজুর রহমান দুলু
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের আদেশক্রমে রেজিস্টার জেনারেল জনাব মোঃ আলী আকবর স্বাক্ষরিত গত ২৩.০৪.২০২০ খিষ্টাব্দ তারিখের ২০৪ নম্বর বিজ্ঞপ্তি মূলে আমরা অবগত হইতে পারলাম যে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অতীব জরুরী বিষয় সমুহ শুনানির নিমিত্ত ছুটি কালীন সময়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জনাব মোঃ নুরুজ্জামান মহোদয় আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্টে বসবেন এবং উক্ত ছুটিকালীন সময়ে হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান মহোদয় সকল অধিক্ষেত্রের অতীব জরুরী বিষয়সমুহ শুনানির নিমিত্ত হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
এই বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর হইতে বিভিন্ন আইনজীবীগণের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিতভাবে আদালত আদালত না খোলার জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সমীপে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জনাব জহিরুল ইসলাম খান পান্না । জনাব জহিরুল ইসলাম খান পান্না সংক্ষেপে জেড আই খান পান্না উক্ত খোলা চিঠি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করার কারণে অনেক আইনজীবী তাহার সহিত সহমত পোষণ করেন। ইহার ফলে তিনি গত ২৪.০৪.২০২০ খ্রিস্টাব্দ তারিখে রাত বারোটার পূর্বমুহূর্তে আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়ে তার মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উক্ত স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন আইনজীবীদের মতামত আদালত বন্ধ করার পক্ষে ৯৩%, খোলার পক্ষে ৪% এবং নিরব ৩%। পরিসংখ্যানগত এই স্ট্যাটাস দেয়ার পূর্বে তিনি আরেকটি স্ট্যাটাসে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছেন এই বলে যে, “হে আল্লাহ রমজানের পবিত্র মাসে কোন কারনেই কোর্টে যেন কোন আইনজীবিকে যেতে না হয়।”
যাহোক, আমার লেখার মূল বক্তব্যে যাওয়ার পূর্বে ইহা অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস, ১৯৭৩ এ উভয় পক্ষের মতামতকে সমুন্নত রেখে আমরা কোন উত্তম উপায় বাহির করতে পারি কিনা যার মাধ্যমে কোর্টও খোলা থাকবে আবার বিজ্ঞ আইনজীবীগণকে কোর্টে যাওয়াও লাগবে না । একই সাথে যে উদ্দেশ্যে মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় যেভাবেই হোক নিয়েছেন সেই উদ্দেশ্য সফল হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস,১৯৭৩ এর Chpater XIA এর ১০ নম্বর রুলে যে পদ্ধতির কথা উল্লেখিত আছে তাহা পালন করলে আমাদের কোনো বিজ্ঞ আইনজীবীকেই আদালতে যেতে হবে না, আবার আদালত বন্ধ করার প্রয়োজনও হইবে না অর্থাৎ আদালত খোলা রেখে গুরুতর প্রকৃতির বিষয় নিয়ে ইমেইলে বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে আইনজীবীগণ কর্তৃক প্রেরিত চিঠি মাননীয় বিচারপতি তার স্বীয় বিবেচনায় আমলে নিয়ে বা বিবেচনা করে রুল নাই সাই এবং অন্য যে কোন প্রকারের প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন। ইহার মাঝে খুবই জনকল্যাণমূলক বিষয় হলো উক্ত ১০ নম্বর রুলে একথা বলা হয়েছে যে উক্তভাবে প্রাপ্ত প্রত্যেকটি চিঠি এক একটি রিট পিটিশনের আবেদন বলে গণ্য হইবে।
ইহা আরও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উক্ত ১০ নম্বর রুল অনুযায়ী যে চিঠির ভিত্তিতে হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি মহোদয় যে রুল নাই সাই এবং অন্যান্য আদেশ প্রদান করিবেন সেই রুল নাই সাই এবং অন্যান্য আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বরাবর প্রেরণ করিবার ক্ষেত্রে কোন প্রকার লত্তয়াজিম (Requisites) প্রদান করতে হবে না । কোন প্রকার কোর্ট ফি প্রদান করিতে হইবে না। অর্থাৎ যে বিজ্ঞ আইনজীবী জনস্বার্থে বা তার মক্কেলের স্বার্থে কোন বিষয়কে একটি সাধারণ চিঠি লিখে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় বরাবর কিংবা সংশ্লিষ্ট বিচারপতি মহোদয় বরাবর কিংবা হাইকোর্ট বিভাগ এর রেজিস্ট্রার বরাবর ইমেইলে বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে প্রেরণ করিবেন তাহাকে তাহার চিঠি উদ্ভূত মামলার ক্ষেত্রে আর কোন প্রকার টাকা খরচ করিতে হইবে না।
আইনের এই সমাধান সূত্র শোনার পর অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, উক্ত ১০ নম্বর রুল এ শুধুমাত্র রিট পিটিশন এর বিষয়ে বলা হয়েছে, তাহলে অন্যান্য বিষয় বিশেষ করে ক্রিমিনাল বিষয়ে একইভাবে চিঠির মাধ্যমে জনস্বার্থে কিংবা মক্কেলের স্বার্থে আবেদন করা যাবে কিনা? উত্তর হলো হ্যাঁ। ২০০১ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তৎকালীন অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডক্টর ফস্টিনা পেরেইরা বিভিন্ন দেশের ২৯ জন বন্দীদের মুক্তির জন্য তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন।
সেই চিঠিটি তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার কে নির্দেশ দেন একটি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করার জন্য এবং সেই নির্দেশ অনুযায়ী সেই চিঠির ভিত্তিতে সুয়োমোটো রুল ইস্যু করা হয় যাহা পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন মাননীয় বিচারপতি জনাব মোঃ হামিদুল হক এবং মাননীয় বিচারপতি জনাব নাজমুন আরা সুলতানা মহোদয়ের গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ কর্তৃক যে রায় প্রদান করা হয়েছিল তাহা 53 DLR (2001) 414 এ রিপোর্টেড হয়েছে।
উপরোক্ত ১০ নম্বর রুল এবং নজির হইতে ইহা সুস্পষ্টভাবে পরিষ্কার যে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় যেভাবেই হোক না কেন যে উদ্দেশ্যে ২০৪ নম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন কোর্ট খোলার জন্য সেই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে উক্ত কোর্ট বন্ধ করার আর প্রয়োজন হইবে না। এভাবে হাইকোর্ট বিভাগে প্রত্যেক বিষয়ের উপরে এক বা একাধিক বেঞ্চ বা কোর্ট চালু করা যেতে পারে যার ফলে উক্ত ২০৪ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সামাজিক দূরত্ব নহে বরং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োজনীয় দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বাড়তি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হইবে না। একই পদ্ধতি অন্নান্য আদালতে বিশেষ করে দায়রা আদালতের খেত্রেও অনুসরণ করা যেতে পারে।
একই সাথে অনলাইনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সকল আইনজীবীর জন্য উন্মুক্ত করে মতামত চেয়ে এবং পেয়ে স্বীয় বিবেচনায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং এর পরে ই- ফাইলিং এবং অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে শুনানির মাধ্যমে কোর্ট পরিচালনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবেন।
মোঃ আজিজুর রহমান দুলু, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী, বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট, E-mail: azizurrahmandulu@gmail.com