রেজাউল ইসলাম
এই লেখাটি আমি যখন লিখছি, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শত শত মানুষ করোনা নামক একটি রহস্যময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। ভাইরাসটি এতই রহস্যময় ও শক্তিশালী যে, উত্তরাধুনিক যুগের কোনো প্রযুক্তিই তাকে বশে আনতে পারছে না। বলা হচ্ছে, ভাইরাসটি ইতোমধ্যে ৩৮০ বার তার জিন বদল করেছে। এমন রহস্যময় আচরণের কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিষেধকও বের করা যাচ্ছে না। ভাইরাসটির আবির্ভাব, আচরণ, কার্যক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মনে তৈরি হয়েছে নানারকম সন্দেহ – সংশয়, জল্পনা -কল্পনা, এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, করোনাভাইরাস উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির তৈরি কোনো দানব নয়তো?
ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলী তার বিখ্যাত ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ উপন্যাসে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামক একজন জার্মান গবেষকের গল্প বলেছেন। তিনি এমন একটি বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন – যা দিয়ে মৃত ব্যক্তির শরীরে প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব। বিজ্ঞান অনুযায়ী তিনি একটি মৃত ব্যক্তির শরীরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান এবং তাতে প্রাণ দিতে সক্ষম হন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ভেবেছিলেন মৃত ব্যক্তিটি হয়তো একজন অতিমানব হয়ে জেগে উঠবেন, কিন্তু হলো উল্টো। তার বিজ্ঞানের কারিকুরিতে মৃত ব্যক্তিটি পরিণত হলো এক আধিভৌতিক দানবে! নিজের সৃষ্টির পানে বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে সেটি তারই সৃষ্টি। দানবটির বিভৎস রূপ দেখে তিনি ভয় পেলেন এবং সাথে সাথেই তাকে পরিত্যাগ করলেন। এতে দানবটি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো এবং তার স্রষ্টার উপর প্রতিশোধ গ্রহণের মনস্থির করল। প্রথমেই সে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সহকারী ড. নীল এবং একজন আয়াকে হত্যা করল। তারপর এক এক করে সেই ভয়ঙ্কর দানবের শিকারে পরিণত হলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভাই, স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। এসব দেখে তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তাই তিনি সেই রক্তপিপাসু দানবকে হত্যার জন্য ধাওয়া করলেন, কিন্তু নিজেই এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মারা যান। এককথায়, এ উপন্যাসে মেরি শেলী দেখিয়েছেন কীভাবে সৃষ্টি তাঁর স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কীভাবে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির কাছে অসহায়ত্ব বরণ করে।
এ লেখায় ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প বলার কারণ হলো, অনেকেই তাঁর সৃষ্ট দানবের সাথে আজকের করোনা ভাইরাসের সৃষ্টির মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, করোনাভাইরাস মানুষের বিজ্ঞান চর্চার কুফল নয়তো? কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এর আবির্ভাব হয়নি তো? কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তা তৈরি করা হয়নি তো? এমন হাজারো প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিচ্ছে। হালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেছে এমন সব কাল্পনিক মন্তব্যে। শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন চিন্তা -ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে না। বরং রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষক, চিকিৎসক সবার মনে একটাই প্রশ্ন, করোনাভাইরাস মনুষ্য সৃষ্ট নয়তো?
চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম যখন এই ভাইরাসটি সনাক্ত হয়, তখন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছে যে এটি একটি জীবাণু অস্ত্র এবং তা উহানের সরকারি গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে। তবে চীনের বিরুদ্ধে জীবাণু অস্ত্র ছড়ানোর কথা প্রথম বলেন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক কর্মকর্তা ড্যানি শেহাম। তাঁর দাবি, চীন উহানের ল্যাবরেটরিতে জীবাণু অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিল – যা অসাবধানতাবশত ল্যাবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা থেকে বিপত্তির সৃষ্টি হয়। তাঁর এই সুরে সুর মেলান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।মি ট্রাম্পকে অনুসরণ করে তাঁর অনেক সমর্থক খোলাখুলি বলছেন, করোনাভাইরাস চীনের তৈরি একটি জীবাণু অস্ত্র।ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কংগ্রেসে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এমন এক রিপাবলিকান রাজনীতিক জোয়ান রাইট টুইট করেছেন, “উহান ল্যাবরেটরিতে এই করোনাভাইরাস তৈরি করা হয়েছে, এবং ঐ গবেষণায় চীনাদের সহায়তা করেছেন বিল গেটস।”
সমালোচনার মুখে পরে অবশ্য তিনি ঐ টুইট ডিলিট করে দেন।তবে আমেরিকার কট্টর ডানপন্থী বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কোনো শেষ নেই।বিশ্ববাণিজ্য হাতের মুঠোয় আনতে জীবাণু অস্ত্রের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর দায়ে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি আদালতে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছে। চীন করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিযোগের গুরুত্ব না দেওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) অর্থ সহায়তা প্রদান বন্ধের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে রেখেছেন।
তবে ঠিক এর উল্টো অভিযোগ করে আসছে চীন ও ইরান। তাদের দাবি, করোনাভাইরাস আমেরিকার তৈরি জীবাণু অস্ত্র। একজন চীনা কূটনীতিক তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, উহানে গত বছরের অক্টোবর মাসে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি দল এই ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে। ঝাও লিজিয়ান নামে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র টুইটারে মার্চের ১১ তারিখে মার্কিন একটি কংগ্রেস কমিটির সামনে সেদেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিবিসি) প্রধান রবার্ট রেডফিল্ডর একটি শুনানির ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেছেন। ঐ ফুটেজে মি. রেডফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা – জনিত মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে বলছেন, পরীক্ষায় দেখা গেছে করোনাভাইরাসের কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। যদিও মি. রেডফিল্ড বলেননি কখন ঐসব মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু চীনা ঐ কূটনীতিক টুইটারে ঐ ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করে সাথে লিখেছেন, ” সিডিসি ধরা পড়ে গেছে। কখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম রোগীটি মারা গিয়েছিল? কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল? কোন হাসপাতালে? হতে পারে যেসব মার্কিন সেনা উহানে ঐ ভাইরাস এনেছিল তারাই…. স্বচ্ছ হোন। মানুষকে সত্য জানান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাই।” মি. ঝাওয়ের ঐ টুইট চীনা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি সিসিটিভিতে প্রচার করা হয়। গ্লোবাল টাইমসেও তা ছাপা হয়। এছাড়া, চীনের অনেক বিজ্ঞানীও দাবি করে আসছেন যে, করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন নয়।
চীনের মতো ইরানের জনগণও বিশ্বাস করে করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার মেজর জেনারেল হুসেইন সালামি সরাসরি বলেছেন, করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি জীবাণু অস্ত্র। সালামির মতো ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য হেশমাতোল্লাহ ফাতালহাতপিকো গত ৬ মার্চ মন্তব্য করেন, ” ট্রাম্প এবং পম্পেও করোনা নিয়ে মিথ্যা কথা বলছেন…. এটা কোনো সাধারণ রোগ নয়, এটা ইরান এবং চীনের বিরুদ্ধে জীবাণু অস্ত্রের হামলা।”
শুধু চীন আর ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে বিশ্বের কিছু নামকরা সংবাদ মাধ্যমও। এই যেমন রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যম চ্যানেল ওয়ান তাদের সন্ধ্যার প্রাইম টাইম সংবাদ অনুষ্ঠান ভ্রেমিয়াতে করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্প্রচার করছে। এর অংশ হিসেবে একজন উপস্থাপক ভাইরাসটির সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সংশ্লিষ্ট করেছেন এবং দাবি করেছেন যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিংবা ওষুধ কোম্পানিগুলো এর পেছনে দায়ী। একইভাবে, জাপানের আসাহি টিভির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ইনফ্লুয়েঞ্জায় ১৪ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সিনা ওয়েইবোর এক ব্যবহারকারী তো একবারে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনাভাইরাসকে চীনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড মিলিটারি গেমসের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি লেখেন, ‘ সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে করোনাভাইরাস উহানে আসে।’
বিশ্বের বড় বড় রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং বিজ্ঞানীরা যখন করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বানাতে থাকেন, তখন সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক যে, ভাইরাসটি তাহলে অবশ্যই উত্তরাধুনিক যুগের প্রযুক্তির ফসল। প্রযুক্তির যথেচ্ছা ব্যবহারই এর পিছনে দায়ী। উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রগুলো আসলে নিজেদের মধ্যে শক্তির খেলায় মত্ত। সে খেলায় জিততে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অবহেলা করে অস্ত্র উৎপাদনে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ ( আইআইএসএস) এর তথ্য মতে, ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া এবং ভারত একত্রে ১.৬৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে সামরিক খাতে – যেখানে ভারতের মতো একটি বৃহৎ ও জনবহুল দেশের ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট বাজেটের পরিমাণ মাত্র ৪১৭.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই একটি তথ্য থেকেই প্রমাণিত হয় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আজ শুধুই অস্ত্র উৎপাদন, যুদ্ধ পরিচালনা এবং বড় বড় সেনাবাহিনী লালন পালনে ব্যস্ত। এই অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় জিততে এহেন কাজ নেই যা তারা করছে না। আজকের মরণঘাতী করোনাভাইরাস হতে পারে তাদের সেই কুৎসিত খেলারই ফলাফল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই ভয়ঙ্কর দানবের মতো করোনাভাইরাস হয়তো কোনো নতুন দানব যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ তার স্রষ্টা (আজকের তথাকথিত উন্নত প্রযুক্তি)।
ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তাঁর সৃষ্টির খেলায় মত্ত হয়ে একটি মৃতদেহ থেকে একজন অতিমানব ( মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক) তৈরি করতে চেয়েছিলেন, আধিভৌতিক দানব নয়। তবুও তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। সর্বস্ব খুইয়েছিলেন তার নিজের তৈরি দানবের হাতেই। করোনাভাইরাস উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির সৃষ্টি হয়ে থাকলে তার স্রষ্টা অবশ্যই তাকে দানব (মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর) হিসেবে পেতে চেয়েছে এবং তা পেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে তার স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব যেভাবে তার স্রষ্টাকে ধ্বংস করেছিল, ঠিক সেভাবে করোনাভাইরাস নামক নতুন দানবটিও তার স্রষ্টা মানবজাতিকে সুন্দর এই পৃথিবী থেকে বিদায় করতে চায়। এখন প্রশ্ন হলো, দানব বনাম মানবের সেই মহাকাব্যিক খেলায় জিতবে কে?
লেখকঃ রেজাউল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
ইমেইল: rezadu367@gmail.com
মতামতের জন্য লেখকই দায়ী থাকিবেন।