শিহাব আহমেদ সিরাজী
আমাদের আইন পেশা, বিচার ব্যবস্থাও এই ভয়াল থাবার বাহিরে নয়। করোনা ভাইরাস সংকটের শুরু থেকেই বন্ধ হয়ে আছে সমগ্র দেশের সকল জেলার সকল আদালত সাথে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। শুরুর দিকে মনে হচ্ছিল আদালতগুলো খোলা থাকা বুঝি আমরা আইনজীবীদের জন্যই বেশি প্রয়োজন, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাস্ট্র আর তার জনগন কোর্ট কাচারী ছাড়াও তাদের জীবন বেশ কাটিয়ে নিতে পারে। আর অন্যদিকে, আদালত বন্ধ তো রুটি রুজিও বন্ধ, সমাজের এমন এক সম্মানজনক পেশায় থেকে কারাে কাছে সহযোগিতা চাওয়াও তো অপরাধ!!
কিন্তু এই স্থবির সময় যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে তত চিৎকার করে জানান দিচ্ছে আইন সেবাও একটি জরুরী সেবা। আইন ছাড়া কোন সভ্য সমাজ চলে না। সীমিত পরিসরে হলেও চলছে ব্যবসা বাণিজ্য, হাসপাতাল, ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কল-কারখানা, গার্মেন্টস, মানুষের প্রত্যাহিক জীবন, ঘটন, অঘটন, স্থিরতা, অস্থিরতা যার ফলে প্রত্যাহ জরুরী হয়ে পড়ছে আইন আশ্রয় নিশ্চিত করার। প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে সীমিত পরিসরে হলেও আদালতের কার্যক্রম শুরু করে মানুষকে তার নূন্যতম মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। কিন্তু এখন বিরাট প্রশ্ন হচ্ছে সেই সীমিত পরিসরে আসলে কিভাবে?? আর এই যে দীর্ঘ দিন আদালত কার্যক্রম বন্ধ তা সমগ্র বিচার ব্যবস্থায় কি প্রভাব ফেলবে?? অতীতের মামলার জট, বর্তমানের জমা যাওয়া অপেক্ষমান মামলা, দীর্ঘ বিরতির পর আদালতের কার্যক্রম কিভাবে সমন্বয় সম্ভব??
ইদানিং খুব করে কথা উঠেছে ভার্চুয়াল কোর্ট শুরু করার। ভার্চুয়াল কোর্ট বলতে সেই কোর্টেকেই বুঝায় যা আসলে ব্যক্তিগত ভাবে একে অপরের সামনাসামনি উপস্থিত না হয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে কোর্ট কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া। ভার্চুয়াল কোর্ট ধারণা আমাদের দেশে নতুন না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংকল্প ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে পথ চলা বর্তমান সরকারের ২০১৫ সাল থেকেই ই-জুডিসিয়ারী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের আইন ও বিচার বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ যৌথভাবে ই-জুডিসিয়ারী প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। যা বাস্তবায়ন করবে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল তথা বিসিসি। ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্পের প্রস্তাব ১২ জুলাই ২০১৯ একনেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (নির্বাহী কমিটি) উত্থাপিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের কর্মপরিধি বৃদ্ধি করে ১০ জেলায় ই-কোর্ট স্থাপনের পরিবর্তে ৬৪ জেলায় ই-কোর্ট স্থাপনের নির্দেশনা প্রদান করেন।
এই প্রকল্পের কর্মপরিধিতে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচারের আওতায় বিচার ব্যবস্থার জন্য এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার উন্নয়ন, বিচার ব্যবস্থার জন্য এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যারের উন্নয়ন, বিচার ব্যবস্থাধীন সব অফিস সংযুক্ত করে একটি ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) তৈরি, সুপ্রিম কোর্টে ডাটা-সেন্টার আপগ্রেডেশন, নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন, দেশের ৬৪ জেলার ১ হাজার ৪০০টি কোর্ট রুমকে ই-কোর্টরুমে রূপান্তর, নিরবচ্ছিন্ন বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা ছাড়া ৬৩ জেলায় ৬৩টি মাইক্রো ডাটা-সেন্টার স্থাপন এবং সুপ্রিম কোর্টের কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টারের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপন। এছাড়া বিচারকদের ২০০০ ট্যাব বা ল্যাপটপ প্রদান, সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ডরুম অটোমেশন এবং পুরনো রেকর্ডগুলো ডিজিটাইজ করা (পাইলট আকারে), আগের বিভিন্ন মামলার রেকর্ড এবং এ সংক্রান্ত রায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং ব্যবস্থা উন্নয়নও এই কর্মপরিধির মধ্যে রয়েছে। এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে ১৯ জানুয়ারি ২০২০ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ, সারাদেশের আদালতে ই-জুডিশিয়ারি ও ই-কোর্ট রুম দ্রুত স্থাপনে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি আগামী ৯০ দিনের মধ্যে ই-জুডিশিয়ারি স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন আদালত।
অর্থাৎ ই-জুডিসিয়ারী বর্তমানে একটি চলমান প্রক্রিয়া, কবে তা পূর্ণাঙ্গভাবে আশার আলো দেখবে তা এখনই বলে দেয়া খুব কষ্টসাধ্য হবে নিশ্চিত। এছাড়াও এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সুপ্রিম কোর্টসহ অন্যান্য জেলার কোর্টরুমের জন্য বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স সিস্টেম স্থাপন, ই-কোর্ট রুম বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট নতুন আইন প্রণয়ন এবং প্রচলিত আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন (সাক্ষ্য আইন, হাইকোর্ট রুলস প্রভৃতি) প্রস্তাব করতে হবে পাশাপাশি বিচারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইসিটি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়াও এই প্রকল্পের আওতায় অবশ্যাম্ভবী। এই সকল ধাপ পেরিয়ে স্বল্প সময়ে ই-জুডিসিয়ারী চালু করার স্বপ্ন নিছক এই সময়ের বিনোদন হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর যদি ভাবা হয় যে, স্বল্প পরিসরে অল্প জ্ঞানে ফেসবুক, ইমেইল, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, জুম এই সকল তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার এর সহযোগিতায় আদালত কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করবো তা হবে নিছক ছেলে মানুষী, বাস্তবতা বিবর্জিত। আমাদের দেশে এখনও বাস্তবতা হলো আমাদের সকল আইনজীবী বা বিচারক বা আদালত প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিজস্ব একটি ইমেইল আইডি নাই, থাকলেও তা নিয়মিত ব্যবহারের অভ্যাস নাই, ব্যবহার যারাও বা করি তারা করি বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীর দেয়া ফ্রি ই-মেইল সেবা, যার বিনিময়ে বিদেশী কোম্পানীগুলো আমাদের সকল তথ্য হাতিয়ে নেয়, আমরা হয়ে পড়ি তাদের পণ্য। এ অবস্থায় আদালতের একেকটি মামলার তথ্য এভাবে অনিরাপদভাবে ছড়িয়ে দেয়ার আদৌ কোন সুযোগ কি আমাদের আছে!!! পাশাপাশি এর জন্য সারাদেশে প্রয়োজনীয় কারিগরী অবকাঠামো প্রস্তুত, প্রশিক্ষণ!! অর্থাৎ ই-জুডিসিয়ারী বা ভার্চুয়াল কোর্ট কোন স্বল্প মেয়াদী সমাধান হওয়ার সুযোগ নেই, হলেও সে হতে পারে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী প্রত্যাশা।
তাহলে কি হতে পারে আমাদের স্বল্প মেয়াদী সমাধান। আমি বারবার ই বলার চেষ্টা করতেছি, প্রথমে বর্তমান সময়ে আইন সেবাকে জরুরী সেবা হিসেবে ভাবতে হবে। শুধু এটুকু ভাবনা ই দিতে পারে অনেক কার্যকরী সমাধান। প্রথমত, বর্তমান সময়ে যে সকল মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ থাকা অতীব জরুরী তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এরপর দ্বিতীয় দফায় চেষ্টা করতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই কোন একটি বা দুইটি কোর্টের উপর যেন মামলার চাপ বেশী না পড়ে যায় যা সোস্যাল ডিসটেন্সিং পালনে অন্তরায় হতে পারে, অর্থাৎ আদালতসমূহের মধ্যে চালিকাভুক্ত অতীব জরুরী কাজের সুষম বিন্যাস করে নেয়া। তৃতীয়ত, আদালত প্রাঙ্গণে শুধুমাত্র আইনজীবী, বিচারক ও আদালত কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য কারো উপস্থিতি যেন প্রয়োজন না হয় এবং উপস্থিত হওয়ার সুযোগ না পায় সেই ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ সীমিত পরিসরে অতীব জরুরী আইন সেবা নিশ্চিত করা।
সর্বোপরি বর্তমান সময়ে যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে ভাবা প্রয়োজন তা হলো আদালতের এই অনাকাঙ্খিত দীর্ঘ বন্ধ আমরা কিভাবে সমন্বয় করবো?? কিভাবে আমরা আমাদের চলমান মামলার জট যেন আরো প্রগাঢ় না হয় সে বিষয় নিশ্চিত করতে পারি?? এ বিষয়ে ভাবতে হবে এখনই। খুব খোলা চোখে দেখলে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার খুব বেশি অপসন আমাদের কাছে নেই। আমরা চাইলেও প্রতিদিন ৮ ঘন্টার জায়গায় ১৬ ঘন্টা করে আদালত খোলা রেখে আমাদের কাজ কমিয়ে আনতে পারবো না। আমরা যা পারবো তা হলো আমাদের আদালত সমূহের এ বছরের পরিকল্পতি প্রাপ্য ছুটির সাথে বর্তমানের সরকার ঘোষিত ছুটির সমন্বয় সাধন। আর সে জন্যও পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এখন ই। নিপাত যাক করোনা, আবার হাসুক বিশ্ব।
লেখকঃ শিহাব আহমেদ সিরাজী, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
লেখকের ব্যক্তিগত মতামত।