বাংলাদেশে ‘আইনের ফাঁকফোকর’ শব্দটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে৷ আইনের ফাঁক গলিয়ে এ দেশে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে৷ অভিযোগ আছে বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে জেল খাটারও৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
বাংলাদেশে মোটা দাগে আইন দু’ধরনের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইনে শাস্তির বিধান আছে৷ এই আইনের মামলায় বাদি আসামির শাস্তি দাবি করেন৷ অন্যদিকে দেওয়ানি আইনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়৷ সাধারণভাবে হত্যা, সন্ত্রাস, হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধের মামলা হয় ফৌজদারি আইনে৷ আর প্রধানত জমি জমা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মামলা হয় দেওয়ানি আইনে৷ এই দু’ধরনের আইনের মামলা তদন্ত, পরিচালনা আর বিচারের জন্য আছে আরো আইন৷ সিভিল প্রসিডিউর কোড এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ছাড়াও সাক্ষ্য আইন এখানে মূল ভূমিকা পালন করে৷
♦ফৌজদারি আইনের দর্শন হলো:
এই আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না৷ আসামিরা সব সময়ই ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এর সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ কারণ এই আইনের বিচারে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ তাই ন্যূনতম সন্দেহ রেখেও কাউকে মুত্যুদণ্ড দেয়া যায় না৷ এখানে অপরাধ প্রমাণ মানে শতভাগ প্রমাণ৷ অন্যদিকে দেওয়ানি মামলায় যেহেতু শাস্তি নয় অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়, তাই কোনো পক্ষ তার দাবি শতকরা ৫০ ভাগের বেশি প্রমাণ করতে পারলেই তাঁর পক্ষে রায় পাবেন৷ বাংলাদেশে আইনের ফাঁকফোকর হিসেবে যেসব ঘটনার উদাহরণ দেয়া হয়, সেইসব মামলা বা অপরাধ সাধারণত ফৌজদারি আইনের৷ আর ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার এবং রায় কার্যকর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে৷ মামলা দায়ের, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র (চার্জশিট) এই তিনটি স্তর সঠিকভাবে সম্পন্ন হলেও কেবল পরবর্তীতে ন্যায়বিচার আশা করা যায়৷ যদি শুরুতেই গলদ থাকে তাহলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হতে পারে৷ ন্যায়বিচার শুধু মামলার বাদির একার নয়, ন্যায়বিচার আসামির জন্যও প্রযোজ্য৷ তাই শুধু আইন-আদালত নয়, তদন্তকারী সংস্থাও পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত৷ আইন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়ই আসলে আইনের চরিত্রকে প্রকাশ করে৷ আইনের ফাঁকফোকর, অপপ্রয়োগ, প্রয়োগ না হওয়া কতগুলো সংস্থা বা বিভাগের ওপর নির্ভরশীল৷
♦কেসস্টাডি – ১
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলা দৈনিক প্রথম আলো একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ সেই প্রতিবেদনে উঠে আসে ফাঁসি কার্যকরের একদিন আগে একজন আসামির দণ্ড কীভাবে স্থগিত হয় এবং তিনি কীভাবে জামিনে বেরিয়ে আসেন৷ তিনি হলেন, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির৷ মানসিক অসুস্থতার ভান করে তিনি ফাঁসি থেকে রেহাই পান৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন৷ দু’জনই ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এসেছিলেন পর্যায়ক্রমে৷ জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলাম ফকিরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়৷ পরে হাইকোর্ট এ রায় বহাল রাখে৷
২০১৩ সালের ১৯ মে খুনের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম ফকির৷ কিন্তু ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর তা নামঞ্জুর হয়৷ ওই বছরের ১৩ নভেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হয়৷ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি পাঠানো হয়৷ কিন্তু ১২ নভেম্বর বন্দি আসলাম ফকির এমন আচরণ শুরু করেন, কারাগারের নথির ভাষায় যেটা ছিল ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’৷ ফলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয় এবং ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়৷
দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হলে আসলামের দণ্ড হ্রাস করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ বিশেষ দিবসে বন্দিদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে চলতি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ৷ ১৩ বছর দু’দিন কারাভোগের পর গত ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম৷
♦কেসস্টাডি – ২
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় চার্জশিটভূক্ত আসামি সাদমান ইয়াসির মাহমুদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ২০১৪ সালের ১ জুন৷ এরপর তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে যান৷ সাদমান হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিম্ন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল৷ সাদমানের আইনজীবী হাইকোর্টে দাবি করেন, ‘‘জবানবন্দিতে সাদমান অন্যদের জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন৷ তিনি রাজীব হত্যায় জড়িত নন৷” এর ভিত্তিতেই তাকে জামিন দেয়া হয়৷ জানা গেছে, সাদমান একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির পুত্র এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল৷
২০১৩ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের পলাশনগর এলাকায় নিজ বাসার সামনে খুন হয়েছিলেন রাজীব হায়দার৷
♦কেসস্টাডি – ৩
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বাখরনগর গ্রামের বাবুল মিয়াকে ডাকাতির মামলায় ১৯৯২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ঢাকার ডেমরা থেকে সিআইডি পুলিশ তাকে যখন গ্রেপ্তার করে তখন তিনি ছিলেন ১৮ বছরের কিশোর৷ চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি যখন তাকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত খালাস দেয় তখন তার বয়স ৪৩ বছর৷ ওই মামলায় তার শাস্তি হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতো৷ কিন্তু বিনা বিচারে তাকে ২৫ বছর কারাগারে আটক রাখা হয়৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটা আদালতের নজরে না আনলে হয়ত বাবুলকে জেলেই মৃত্যুবরণ করতে হতো৷
১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট রাত ৮টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ে তিনি যাত্রী হয়ে একটি বাসে থাকাকালে একদল ডাকাত বাসে ডাকাতি করে৷ ডাকাতরা ডাকাতি করে চলে গেলেও বাসের হেলপার নজরুল ইসলাম সন্দেহবশে তাকে অভিযুক্ত করে ডেমরা থানায় একটি ডাকাতি মামলা করেন৷ পুলিশের ডেমরা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আশ্রাফ আলী সিকদার তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন৷ কিন্তু বিচার শুরুর ২৪ বছরে মামলার ১১ সাক্ষীর মধ্যে আদালতে মাত্র ৪ জন সাক্ষ্য দেন৷ মামলার বাদি ও তদন্ত কর্মকর্তা কখনই আদালতে হাজির হননি৷
♦কেসস্টাডি – ৪
গত মে মাসে টাঙ্গাইলের সখীপুরে একটি সন্ত্রাসী হামলার মামলায় নামের মিল থাকায় মূল আসামির বদলে রফিকুল ইসলাম (৩৫) নামের এক দিনমজুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হলে ছয় দিন কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান৷ দু’বছর আগেও ২০১৫ সালের ১৪ মে একই মামলায় এই রফিকুলকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ৷ তখন তিনি তিন দিন কারাগারে ছিলেন৷ কিন্তু মূল আসামি রফিকুল ঘটনার পর বিদেশে চলে গেছে৷
♦কেসস্টাডি – ৫
গত ১৯ অক্টোবর খুলনার খানজাহান আলী থানার আটরা পালপাড়ায় শেখ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে ডাকাতি হয়৷ মুখোশধারী ডাকাত দল ওই বাড়ির নীচ তলায় গেট ভেঙে প্রবেশ করে জব্বারের মেয়ে লিপি খাতুনের হাত-মুখ বেধে তাকে বেধে রেখে ডাকাতি করে৷ ডাকাতরা সোনার গয়নাসহ দুই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়৷ কিন্তু পুলিশ ডাকাতির মামলা নেয়নি৷ লিপি খাতুনকে চুরির মামলা দিতে বাধ্য করে৷
♦এই ৫টি কেসস্টাডি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আইনের ফাঁকফোকর নয়, আইনের অপব্যবহার বা আইন মানা হয়নি৷ ‘‘আইন যাঁরা প্রয়োগ করেন তাঁদের ওপরই আইনের যথার্থতা নির্ভর করে৷ আইনের উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা৷ তবে আইনে ত্রুটি থাকতে পারে৷ আইনেরও অপব্যবহার হতে পারে৷ আবার আইনের প্রয়োগ নাও হতে পারে৷ এমনকি নিবর্তনমূলক আইনও হতে পারে৷ ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে তাতে মনে হতে পারে আইনে ফাঁকফোকর আছে৷ কিন্তু আইনের ছাত্র হিসেবে আমি আইনে ফাঁক ফোকর কথাটি গ্রহণ করতে পারি না৷”
♦ ‘‘৫৪ ধারা একটি নিবর্তনমূল আইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ বিশেষ ক্ষমতা আইনও তেমন৷ কিন্তু এরসঠিক ব্যবহার হলে কিন্তু তা নাগরিকদেও কল্যাণেই আসে৷
♦‘‘বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় চারটি পক্ষ কাজ করে৷ পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত এবং কারাকর্তৃপক্ষ৷ এখন যে কোনো এক পক্ষের অদক্ষতা বা অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে৷ অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাতে পারে৷ আবার নিরপরাধ কেউ শাস্তি পেয়ে কারাগারে যেতে পারে৷”
‘‘ঢাকার নিম্ন আদালতের মামলা পর্যালেচনা করেও দেখা গেছে যে সর্বোচ্চ ১৫-২০ ভাগ মামলায় আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেছে৷ ৮০ ভাগ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷ আর এর পিছনে নানা কারণ আছে৷ কিন্তু প্রধান কারণ হলো পুলিশের তদন্তে দুর্বলতা৷ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়ে আদালত তা বলেছেন৷ এটা ইচ্ছা করে হতে পারে, আবার অদক্ষতার কারণেও হতে পারে৷ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ময়নাতদন্তেও অসততার কথা বলেছে আদালত৷”
বাংলাদেশে আইনে যেমন ত্রুটি আছে, আছে সাক্ষ্য আইনে দুর্বলতাও৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ আর সংঘবদ্ধ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এ আইনে শাস্তি দিতে হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়৷ প্রয়োজন হয় চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদসহ অন্যান্য দালিলিক সাক্ষ্য৷ সঠিক সময় ডাক্তারি পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না৷ বহুল আলোচিত ঢাকার বনানি ধর্ষণ মামলা যার প্রমাণ৷ এছাড়া আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীকেই ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে হয়, যা একটি কঠিন এবং জটিল প্রক্রিয়া৷
ফলে ধর্ষণের শাস্তি অনেকক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায় না৷ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব মতে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৬টি, যার মধ্যে বিচার শেষ হয়েছে ৩৫৯টির৷ বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আসামি ছিল ৩৯৩ জন, যার মধ্যে ৩৬৬ জনই খালাস পেয়ে যায়৷
২০১৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়ন করা হয়৷ এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ নির্যাতনে মাধ্যমে কারুর মৃত্যু হলে দায়ীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যাবে৷ শুধু নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্যাতনের মাত্রা বিবেচনায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনে৷ কিন্তু আইনে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে৷ ফলে অপরাধী শুধু জরিমানা দিয়েই মুক্তি পেতে পারেন৷ আবার অস্ত্র এবং মাদক আইনের মামলায় অপরাধ প্রমাণ করতে হলে কোনো ব্যক্তির দখলে ওই অস্ত্র বা মাদক পাওয়া জরুরি৷ কেউ ওই অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও তাদের কাছে বা দখলে না পাওয়া গেলে তারা আইনে সুবিধা পান এবং অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়৷ আবার আইনের বিধানের কারণেই কারুর পকেটে অস্ত্র বা মাদক দিয়ে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দেয়া যায়৷
যৌতুক বিরোধী আইনে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেয়া যে কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝাবে৷ তবে কোনো উপঢৌকন যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না৷ আর এই উপঢৌকনের আড়ালেই চললে যৌতুক দেয়া নেয়া৷
মানহানির একই অপরাধে বাংলাদেশে দুই ধরনের আইন আছে৷ পত্রিকা বা বইয়ে লিখে কারুর মানহানি করলে তার শাস্তি ৫০০ ধারায় দুই বছরের জেল৷ এই একই অপরাধ অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে করলে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধরায় ১৪ বছরের জেল৷ ৫৭ ধারায় কারুর অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই তিনি মামলা করতে পারেন৷ এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এই আইন দিয়ে হয়রানি ও মিথ্যা মামলা দেয়া যায়৷ ‘‘কেউ যদি সঠিক তথ্য প্রমাণসহ কারুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়৷ আর যে কোনো ঘটনায় মিথ্যা মামলার সুযোগ তো আছেই৷ জামিন অযোগ্য মামলায়ও বিচারক যদি সন্তুষ্ট হন তাহলে জামিন দিতে পারেন৷ এখন প্রশ্ন হলো, বিচারক তথ্য প্রমাণসহ যৌক্তিক কারণে কি সব সময় সন্তুষ্ট হন?’ বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহ ও আদালত অবমাননার বিষয়টিও আইনে অস্পষ্ট৷ এখানে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অধিকাংশ মমলাই হয় সরকার বিরোধিতা বা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করলে৷ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনামূলক কথাও রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে ফেলে দেয়া হয়৷ কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রমাণসহ কিছু লিখলে বা বললেও৷ কোনো রায়ের সমালোচনা করলেও তা আদালত অবমাননা হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে৷ তাছাড়া সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতা অথবা সুনির্দষ্টতার কারণে কোনো হত্যাকাণ্ড বা নেপথ্যে ইন্ধনদাতার অপরাধ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব৷ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদেও আইনের আওতায় আনা যায়নি৷
♦‘‘আইনের বেসিক প্রিন্সিপল হলো উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা রক্ষা করা৷ এখন ফৌজদারি আইনে ১০০ টাকাও চুরি আবার ১০০ কোটি টাকাও চুরি৷ ১০০ টাকা চুরি করলে জেলে যাবেন আর ১০০ কোটি টাকা চুরি করলে ভিআইপি স্ট্যাটাস পাবেন৷ এই পাবলিক পারসেপশন থেকে আইনের ফাঁকফোকরের কথা বলা হয়৷ মনে করা হয় আইনে কোথাও ফাঁকফোঁকর আছে৷ আসলে এটা আইনের প্রয়োগগত সমস্যা৷ ব্রিটিশরা এই আইন যখন করে তখন চুরির শাস্তি দেয়ার চেয়ে চোর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণাত ছিল বেশি৷ ১৮ শতকের ব্রিটিশ আইনকেই আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীকরণ করেছি৷ কিন্তু সেই আইন দিয়ে আজকের সময়ের মানুষের মর্যাদা, মনন কোনোটাই ধারণ করা সম্ভব নয়৷”
‘‘আমরা এখন বলি আইনের শাসন না থাকলে এটা থাকবে না, ওটা থাকবে না৷ কিন্তু এই আইনের শাসন হলো একটা মিথ্যা আশ্বাসের জায়গা৷ কারণ যে কলোনিয়াল আইন হয়েছে আপনাকে-আমাকে দমন-পীড়নের জন্য, সেই আইনগুলো বহাল থাকলে আপনার-আমার সম্মান, ন্যায়বিচার, মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে না৷ সেজন্য নতুন ‘সেট অফ ল’-এর প্রয়োজন৷ নতুন আইনের প্রয়োজন৷”
‘‘এছাড়া একই অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন ও সাজার বিধানসহ আইনে অনেক ‘কন্ট্রাডিকশন’ আছে, যা দূর করা প্রয়োজন৷”
ফেসবুক কর্নার