সোয়েব সিহাব
(ইচ্ছাকৃতভাবে সঙ্গম কখন হবে, সম্মতি থাকলে কি হবে, বয়সের বিষয়, নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাদের আইনে ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হতে পারে কিনা আর হলে সেটা কোন আইনের অধীনে আছে সেই বিষয়টিকে তুলে ধরা।)
ছেলে শিশু ভিকটিম যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সেটা ধর্ষণ হবে কিনা/ধর্ষণ হতে গেলে কোন বিষয়গুলে থাকা জরুরি তা জানা দরকার। বাংলাদেশে ধর্ষণ ও অস্বাভাবিক অপরাধ(বলাৎকার নামে পরিচিত) নিয়ে পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশান ৩৭৫ এবং ৩৭৭ তে বলা আছে। এছাড়াও পরবর্তীতে ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ সেকশান ৯ এও ধর্ষণ নিয়ে বলা আছে।
সমস্যাটা হলো ‘পেনাল কোড ১৮৬০’ এবং ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ এ দুটি আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞাগত একটা জটিলতা রয়েছে, যার কারণে ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সেটা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর অধীনে ধর্ষণ হবে নাকি পেনাল কোডের অধীনে অস্বাভাবিক অপরাধ(বলাৎকার নামে সবাই চিনি) হবে!!
যাই হোক, এ বিষয়টার বিশ্লেষণ করার জন্য পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশান ৩৭৫, ৩৭৭ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, সেকশান ২(ঙ,ছ,ট), ৩, ৯(১) এসব সেকশানগুলোর সাহায্য নিবো।
এখন দেখার চেষ্টা করি সাধারণত ধর্ষণ বলতে কি বুঝায়ঃ
পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশান ৩৭৫ অনুযায়ী,
“কোন পুরুষ অতঃপর উল্লেখিত ব্যতিক্রম ভিন্ন অপর সকল ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পাচটি যেকোন অবস্থায় কোন স্ত্রীলোকের সাথে যৌনসঙ্গম করলে সে ধর্ষণ করেছে বলে পরিগণিত হবে।
প্রথমত:- স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ।” …………(এরকম আরও কয়েকটি উপাদানের কথা বলা আছে। আমরা সেগুলোতে যাবো না। প্রথম অংশটুকু থেকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।)
প্রথম অংশটি থেকে যেটা বুঝা গেলো ধর্ষণ হতে হলে অবশ্যই একজন পুরুষ কর্তৃক একজন নারীর সাথে যৌনসঙ্গম করা লাগবেই। যৌনসঙ্গম কখন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে সে বিষয়ে যাবো না কারণ আমাদের আলোচনার বিষয় একজন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হতে পারে কিনা আর বাংলাদেশের আইন এটা নিয়ে কি বলে।
এখন চলে যাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ
যদিও পেনাল কোড ১৮৬০ এ নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে প্রবিশন ছিলো তবুও পরবর্তী পরিস্থিতিতে এ অপরাধগুলোকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য এই স্পেশাল আইনটি করা হয়েছে। ধর্ষণ নিয়ে এ আইনের সেকশান ৯(১) এ বলা আছে,
“যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷”
এখানে বলা আছে পুরুষ কর্তৃক নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করার কথা। তাহলে প্রশ্ন হলো ধর্ষণ কি, নারী কে আর শিশু বলতে কাকে বুঝাবে? সমাধানটা এ আইনেই দেয়া আছে।
নারী কেঃ ২(ছ) “নারী” অর্থ যে কোন বয়সের নারী;
শিশু কেঃ ২(ট) “শিশু” অর্থ অনধিক ষোল বত্সর বয়সের কোন ব্যক্তি;ল
তার মানে শিশু বলতে ১৬ বছরের নিচে সকল ছেলে ও মেয়েকেই বুঝাচ্ছে। ঝামেলাটা এখান থেকেই শুরু!!
সেকশান ৯(১) এ ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া নাই, যেতে হবে সেকশান ২(ঙ) তে,
“ধর্ষণ” অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, Penal Code, 1860 (Act XLV of 1860) এর Section 375 এ সংজ্ঞায়িত rape”;
এখানে আবার আরেক ঝামেলা! ২(ঙ) বলছে সংজ্ঞা নেয়ার জন্য আমাদেরকে আবার সেই পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশান ৩৭৫ এ যেতে হবে তবে ২০০০ সালের আইনের ২(ঙ) বলছে এই আইমের ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিতে হবে পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারা থেকে। তার মানে ২০০০ সালের আইনের ধারা ৯ বলতেছে কোন পুরুষ কোন নারী বা কোন শিশুকে ধর্ষণ করলে………। আর ৩৭৫ বলছে ধর্ষণ তখনই হবে যখন একজন পুরুষ একজন নারীর সাথে যৌনসঙ্গম করবে, মনে রাখতে হবে এখানে শিশু/ছেলে শিশুর কথা বলা নাই।
তাহলে সমস্যা দেখা দিলো ২০০০ সালের স্পেশাল আইনের সেকশান ৯(১) ও পেনাল কোডের সেকশান ৩৭৫ নিয়ে। পেনাল কোডে ধর্ষণের সংজ্ঞায় শিশুর কথা উল্লেখ নাই, কিন্তু ২০০০ সালের আইনে বলা আছে একজন পুরুষ কর্তৃক নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করার কথা। আবার ২০০০ সালের আইনে শিশুর সংজ্ঞাতে ১৬ বছরের নিচের সবাইকেই বুঝাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো কোনটাকে প্রাধান্য দিবো? এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজবো ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ সেকশান ৩ এ
“আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর থাকিবে৷”
তার মানে এই আইনের সাথে অন্য কোন আইনের ঝামেলা দেখা দিলে এই আইনে যা বলা আছে সেটাই প্রাধান্য পাবে।
তাহলে বিষয়টা কেমন দাড়ালো!! পেনাল কোড বলছে শুধু পুরুষ কর্তৃক নারীর সাথে যৌনসঙ্গম আবার ২০০০ সালের স্পেশাল আইন বলছে শুধু পুরুষ কর্তৃক নারী বা শিশুকে। ২০০০ সালের ঐই আইনের সেকশান ৩ আবার নিজেকেই নিজে প্রাধান্য দিচ্ছে।
এবার আসি বাস্তবতায়, বাস্তবে সাধারণত পুরুষ কর্তৃক কোন ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সেটার জন্য কোন আইনে চার্জ শিট করা হয়?
আমার জানা মতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আইনগত এ জটিলতার কারণে পেনাল কোড ১৮৬০ সেকশান ৩৭৭ অনুসরণ করা হয়,
“কোন ব্যক্তি যদি প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কোন পুরুষ, স্ত্রীলোক বা পশুর সাথে যৌন সঙ্গম করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজীবন কারাদণ্ডে, অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।”
‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ সেকশান ২ এ শিশুর সংজ্ঞা দিয়েছে সেখানে ছেলে মেয়ে উভয়কে বুঝিয়েছে। ২(ঙ) আবার ধর্ষণের সংজ্ঞায় ৯ কে ফলো করে পেনাল কোডের ৩৭৫ এ যেতে বলেছে । ৩ এ ওভার রাইডিং ইফেক্ট দেওয়া হয়েছে।
আর ৯ এ শিশু শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে।
এর দ্বারা বুঝা যায় লেজিসলেটার ইচ্ছাকৃত ভাবে শিশু ( ছেলে মেয়ে) উভয়কে এই আইনের আওতায় আনতে চেয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সালের সেকশান ২(ঙ,ছ), ৯(১) এবং সেকশান ৩ কে সম্মিলিতভাবে দেখলে এটা বলা যেতে পারে একজন ছেলে শিশুও একজন পুরুষের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারে, বাংলাদেশের আইনে এ বিষয়টা আছে যদিও অনেক জটিলতা ও অস্পষ্টতা রয়েছে।
সোয়েব সিহাব,
আইন বিভাগ, ঢাবি।