নুরন্নবী সবুজ
নিয়মিত সারা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা বের করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যেমন কতগুলো ধাপ আছে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব মান নির্ণয় করারও কিছু পদ্ধতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয় যেন তার সঠিক চরিত্র অর্জন করতে পারে ও পরিবর্তগুলোর সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার ব্যবস্থা করতে পারে তার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠান তাদের বিশেষ মানদন্ড প্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাইয়ের কাজ করে থাকে। এমনি ৩ টি প্রতিষ্ঠান হলো টাইমস হায়ার ইডুকেশন ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি, কিউিএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি ও একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি। প্রত্যেকের প্রায় সমজাতীয় কিন্তু আলাদা আলাদা মানদন্ড নির্ধারন করা আছে যার মাধ্যমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করে থাকে।
টামাইস হায়ার ইডুকেশন ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটির র্যাংকিং পদ্ধতিতে মূলত ৫ টি পদ্ধতি অনুসরন করা হয়। এই ৫ টি পদ্ধতি অনুসরন যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। ১. সাইটেশন ২. টিচিং ৩. রিচার্জ ভলিউম ও ইনকাম ৪. আন্তর্জাতিক বৈচিত্রতা ৫. ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম। এই ৫ টি পদ্ধতি দ্বারা এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমান নির্ধারন করে থাকে। সাইটেশন: গবেষণা বা নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ । পরিবর্তনের সাথে যেন ইতিবাচক ভাবে খাপ খাওয়ানো যায় ও জ্ঞান বিজ্ঞান মানুষের কাজে লাগে ও তা সহজ লভ্য হয় তার প্রচেষ্টাই এই সাইটেশন। সাইটেশনের জন্য ৩২.৫ ভাগ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকে। টিচিং:শুধুমাত্র কোন শিক্ষকের ক্লাস নেবার বিষয়টি এখানে অন্তর্ভূক্ত নয়। এটি এখানে অনেক বৃহৎ অর্থে ব্যাবহার করা হয়।
টিচিংয়ের ক্ষেত্রে মূলত ৫ টি বিষয় আওতাভূক্ত করা হয়েছে। ক. শিক্ষকদের পিএইচডি‘র সংখ্যা খ. শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত গ. শিক্ষকদের পরিচিতি বিষয়ক সমীক্ষা ঘ. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি পরিমাণ পিএইচডি ডিগ্রী ও অন্যান্য ডিগ্র্রী দেয়া হয়। ঙ. শিক্ষার্থী প্রতি শিক্ষকদের আয় রিচার্জ ভলিউম ও ইনকাম: গবেষণা যদি সমাজের কাজে না লাগে তাহলে তার বাস্তব মূল্য তৈরী হয় না।
সমাজকে সুন্দর করতে গবেষণার প্রয়োজন। আর প্রত্যেক পরিশ্রমের পিছনে কিছু পুরস্কার প্রাপ্তি পরবর্তী কাজ করতে উৎসাহিত করে । আর এই ব্যবস্থায় এই দিকগুলোর দিকেই নজর রাখা হয়েছে। রিচার্জ ভলিউয়ম ও ইনকামে ৫ টি বিষয়কে গুরুত্বকে দেয়া হয়েছে ক. বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কতটুকু জনপ্রিয় সে বিষয়ক সমীক্ষা খ. প্রতিটি গবেষণা থেকে একজন শিক্ষকের আয়। গ. গবেষণার আকার, বিষয়বস্তু এবং সৃজনশীলতা। ঘ. সকল গবেষণা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয়। আন্তর্জাতিক বৈচিত্রতা: বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র নিজের দেশের শিক্ষার্থীই থাকবে না বরং শিক্ষার মান যদি ভালো হয় তাহলে তাতে বাইরের শিক্ষার্থীও থাকবে। আন্তর্জাতিক বৈচিত্রতায় মূলত দেখা হয় বাইরের দেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম: গবেষণার বাস্তব উপযোগিতার পাশাপাশি নানা কারনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি ইনকামের উপর ২.৫ ভাগ পয়েন্ট বরাদ্দ করা আছে।
কিউএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণে বেশ জনপ্রিয় । এরা ৬ বিষয়ের উপর তাদের সমীক্ষা চালিয়ে মান দিয়ে থাকে। ১. শিক্ষক/গবেষকদের খ্যাতি ২. নিয়োগকর্তা/নিয়োগের খ্যাতি ৩. শিক্ষক/ছাত্রছাত্রী অনুপাত ৪. শিক্ষক/গবেষক প্রতি সাইটেশন সংখ্যা ৫. আন্তর্জাতিক শিক্ষক/গবেষক অনুপাত, ও ৬. আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী অনুপাত। শিক্ষক/গবেষকদের খ্যাতি: ভালো কাজের প্রসংশা করার অভ্যাস যেমন আমাদের আছে তেমন খারাপ কাজের নিন্দা করার মত অভ্যাসও আমাদের কম নয়। আর তাই নাম বা দুর্নাম দ্রুত ছড়ায়।
শিক্ষকদের বা গবেষকদের খ্যাতি নির্ণয়ে ৮০ হাজার অভিজ্ঞ শিক্ষক বা গবেষকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মূলত এই তালিকা সাজানো হয় । আর এর উপর পয়েন্ট থাকে ৪০ ভাগ। নিয়োগকর্তা/নিয়োগের খ্যাতি: শিক্ষা জীবন শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা কর্ম ক্ষেত্রে কেমন অবদান রাখছে তার গুরুত্ব কম না। বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছে কিনা সেটি নির্ধারন করা হয় এই পদ্ধতির মাধ্যমে। যোগ্যতা সম্পূর্ণ ও পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে কেমন উপযোগী জনগোষ্ঠী তৈরী করা হবে তার গুরুত্ব তৈরীতে এই পদ্ধতি অনুসরন করা হয়। শিক্ষক/ছাত্রছাত্রী অনুপাত: শিক্ষক যদি শিক্ষার্থী অনুপাতে যতেষ্ট না হয় তাহলে শিক্ষার মান কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এতে করে শিক্ষার্থীদের মনযোগ ধরে রাখাও কষ্টকর হয়। অনেক সময় অধিক চাপ পড়ে যায় শিক্ষকগণের উপর । গবেষণার কাজ বা শিক্ষার কাজ এতে ব্যহত হয় ।
তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতকে গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। শিক্ষক/গবেষক প্রতি সাইটেশন সংখ্যা: শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণায় অংশগ্রহন ও তার মান এখানে বিবেচনা করা হয়। ৫ বছরের সাইটেশন সংখ্যাকে মোট গবেষক দ্বারা ভাগ করে কাজের অনুপাত করা হয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষক/গবেষক অনুপাত: একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি সামগ্রিক অবস্থা ভালো হয় তাহলে তা সহজেই স্কলারদের পছন্দের হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্মগুনে কি পরিমান বিভিন্ন দেশের স্কলারদের আকৃষ্ট করাতে পারছে ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অন্তর্ভূক্ত করতে পারছে সেটি খুব গুরুত্ব দিয়ে এখানে বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী অনুপাত: পছন্দের তালিকায় সে সব বিশ্ববিদ্যালই থাকবে যাদের সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উপযুক্ত। কোন বিশ্ববিদ্যালয় তার গুণে কি পরিমান বাইরের শিক্ষার্থীকে অকৃষ্ট করতে পারছে তার অনুপাত এখানে বিবেচনা করা হয়। একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করতে ৪ টি বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। ১. কোয়ালিটি অব ইডুকেশন ২. কোয়ালিটি অব ফ্যাকাল্টি ৩. রিচার্জ আউটপুট ৪. পার ক্যাপিটা এ্যাকাডেমিক পারফরমেন্স ( পিপিপি ) যে প্রতিষ্ঠান যেই পদ্ধতিতেই তাদের এই মান গুলো নির্ধারণ করুক না কেন একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দূর্বলতাগুলো কটিয়ে দ্রুত বিশ্ব মানের হয়ে উঠবে এমন ভাবনা প্রত্যেকটি সচেতন নাগরিকের আছে। এর জন্য হয়ত আমাদের কিছু ছাড় দিতে হবে কিন্তু তার প্রাপ্তি যে অনেক বেশী।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট। mdnurunnobiislam379@gmail.com