নাহিদ শাহীন
মনে হয়েছে মৃত্যু ভয় হচ্ছে মানুষের জীবনে সবচেয়ে নির্মম ও মর্মন্তুদ। কিন্তু সেটিও যে কোনোভাবেই আজকাল মানুষকে দমাতে পারে না তার প্রমান দিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের মানুষগুলো। পুরো বিশ্ব যেখানে করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় তছনছ। লাখো মৃত্যু শোকে যখন গোটা বিশ্ব স্তব্ধ বিহ্বল, সেখানে কি না আমাদের দেশের মানুষগুলো খাম খেয়ালই করেই যাচ্ছে। মানুষকে ঘরে থাকার রাষ্ট্রীয় অনুরোধ, সামাজিক সচেতনা কোনটিই যখন কাজে আসছিল না তখন বাধ্য হয়েই দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীকে মাঠে নামাতে হলো মানুষকে ঘরে তোলার জন্য। দেখা গেলো গরু ছাগলকে লাঠি হাতে যেমন গোয়ালে তুলতে হয় একই কায়দায় মানুষকে ঘরে তোলার আপ্রান চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। তাতেও কাজ হচ্ছে না।
হাঁটে বাজারে মানুষ, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ, পাড়া মহল্লায় মানুষ, দোকানে দোকানে মানুষ। কেনোভাবেই মানুষদের মৃত্যু ভয় আতংকিত করছে না। সেনাবাহিনীর হুংকার, পুলিশ বাহিনীর ভীতি প্রদর্শন এবং সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর বিনীত অনুরোধ ও বোঝ ও সচেতনতামূলক শ্লোগান আমলেই নিচ্ছেনা জনসাধারণ।
আইন মানছে না, রাষ্ট্রীয় বিধি মানছে না। তাহলে কিভাবে কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত সেটি এখন ভাবনার বিষয়।
ঘরে না থাকলে এই প্রানঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যাবে না এটি এদেশের মানুষের মগজে ঢুকছে না, তাহলে কি হাজার লক্ষ মানুষ মৃত্যু বরণ করবে?
বিশ্বের উন্নত অনুন্নত দেশ পুরো মাত্রায় লক ডাউন, সামাজিক দুরত্ব, হোম কোয়ারান্টাইন, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছে। তাহলে ওসব দেশের মানুষ কি বেশি সচেতন না রাষ্ট্রের আইন বিধি শক্তিশালী না তারা তুলনামূলকভাবে সভ্য। অবশ্য সভ্যতার ইতিহাস সংস্কৃতির হিসেব করতে গেলে বিষয়টি অন্য লাইনে চলে যাবে, এখানেই থাকি।
রিকশাওয়ালার ঘরে খাবার নেই- তাই তার রাস্তায় নামতে হয়
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ির ঘরে খাবার নেই- তাই তার রাস্তায় নামতে হয়।
দিন মজুর, গার্মেন্টস কর্মীদের ঘরে খাবার নেই-তাই রাস্তায় নামতে হয়।
এসব অজুহাত বা আরো হরেক রকমের তথ্য উপাত্ত দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে মানুষজন।
এগুলো যে সত্যি নয় তা কিন্তু নয়।
ত্রাণ বাড়ি বাড়ি পৌঁছেনি এমন প্রমান পাওয়া যাচ্ছে চতুর্দিক থেকে।
আবার ত্রানের চাল চুরি ও সেগুলো অন্যত্র বিক্রি করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
তাহলে কি ঘটবে এ জাতির ভাগ্যে?
বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশগুলো লক ডাউনের সাথে সাথে খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পন্য সামগ্রিই ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। যেমন-জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন- ঘরে থাকুন জীবনের প্রয়োজনে যা কিছু দরকার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিবো। আর আমাদের দেশে ত্রান চুরি হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের দূর্বলতা না জনগন নিজে থেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেতন হচ্ছে না। কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা যায়?
ধরুন বৃটিশ থেকে ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া স্বাধীন হবার পর এবং ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর আলাদা হবার পর তাদের মতো পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনে দেশের এতো অল্প সময়ে জাতিকে সভ্য ও অর্থনৈতিক ভাবে ইস্পাতের মতো শক্তিশালী করতে পারার কাহিনী নেই।
ভাবুন আমাদের দেশও পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছে ওই দুই দেশ থেকে মাত্র দশ বারো বছর পর। কিন্তু আমাদের জাতি হিসেবে না করা গেলো সভ্য না সচেতন না দেশকে স্বচ্ছ চকচকে করা গেলো মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের মতো। তাহলে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণটা কি আমরা উদঘাটন করতে পারছি।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হলেও এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে দেশের অন্যন্যা বিরোধী দলের সহযোগিতা নেই। সংকটে দূর্যোগে, মহামারিতে দেশের ক্রান্তিকালে তাই এক সাথে মিলিত হয়ে আপদকালীন সংকট দূরীকরণে এগিয়ে না আসার সংস্কৃতি এদেশের জন্মলগ্ন থেকেই।
যে কারণে এ দেশের রাজনৈতিক কুট- কৌশল একই সাথে শ্রেনীগত মানুষের মন মানসিকতা উধার ও সুচিন্তিত না হওয়ায় এদেশের ভাগ্য বদলে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। দেশের প্রকৃতিই এমন হয়ে যাচ্ছে যে আমি আপনি নিজে থেকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছি না।
৭১ এর ঘাতকদের দৃশ্যমান অবয়ব ছিলো, তাদের হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের পরাজিত করতে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে পেরেছি।
করোনা ঘাতক অদৃশ্যমান কোনো রক্তপাত নয় এ যুদ্ধে শুধুমাত্র বুদ্ধি ও সচেতনতার মতো অস্ত্র ঠিক নিশানায় রাখলে মুক্ত হবো নিজেরা, মুক্ত হবে দেশ এই ধৈর্য্যটুকু ভেতরে লালন করতে পারছিনা। মূলত খাদ্য সংকট নাকি নিজেদের অসচেতনতাই দায়ই সেটি দেখতে দেখতে দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আল্লাহ জানে।
তাই আসুন সচেতন হই, আর মাত্র কিছুদিন ঘরে থাকি। তারপর স্বাভাবিক হবে পৃথিবী। নতুন সূর্য উঠবেই। ইনশাআল্লাহ।
লেখকঃ নাহিদ শাহীন, আইনজীবী ও লেখক, জজ কোর্ট, ঢাকা ।