জিনাত জাহান
সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখলাম, করোনা সংকটের এ সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করার সময় অমুসলিম হওয়ার কারণে একজন মাওলানা সাহেব কিছু লোককে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর এ বিষয়টি ঘিরে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অমুসলিম কাওকে সাধারণ দান-সাদাকাহ (যাকাত ব্যতীত) করার ক্ষেত্রে ইসলাম কী বলে, এ লেখায় এ বিষয়টি শেয়ার করব।
ইসলাম মূলত মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে দান-সাদকা (যাকাত ব্যতীত) করার অনুমতি প্রদান করেছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ২৭২ নং আয়াতে “হেদায়েত” ও “দান-সাদকার” ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, হেদায়েত আল্লাহ তাআলার হাতে। আপনি বিশ্ববাসীকে এটা জানিয়ে দিন যে, প্রত্যেকের দান-সাদকা প্রকৃতপক্ষে তার নিজের উপকারেই আসবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।
সুরা বাকারার এই ২৭২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সা. কে এমন ইঙ্গিত প্রদান করে বলেন- যারা আপনার বিরোধিতা করে তাদের প্রতি দান-সাদকা বন্ধ করে তাদেরকে ইসলামে প্রবেশের ব্যবস্থা করা আপনার দায়িত্ব নয়; বরং আপনার দায়িত্ব হলো তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়া।
এ আয়াতের শানে নুজুলের ব্যাপারে ইমাম রাজি র. একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। হযরত আবু বকর রা. এর কন্যা হযরত আসমা রা. এর মা একবার হযরত আসমা রা. এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন হযরত আসমা রা. এর মা মুশরেক ছিল।
হযরত আসমা রা. প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুশরেক আত্মীয়দেরকে দান করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে এ আয়াত নাজিল হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে দান-সাদকা করার অনুমতি দান করেন। (বুখারী শরীফ-২৯৪৬/তাফসিরে মাজহারি)
মুসনাদে আহমাদ এর ২৪৮১৫ নং হাদীসে হযরত আয়েশা রা. এক ইহুদী মহিলাকে দান করেছিলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। হিলিয়াত আল উলামা, খন্ড ০৩, পৃষ্ঠা ১৫৪তে অমুসলিমদের দান করার ক্ষেত্রে বাঁধা নেই, এমনটাই বলা হয়েছে।
মুনাফিকদের মাঝ থেকে আল্লাহর রাসূল সা. এর দান সাদকার বন্টন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের পরও সুরা তওবার ৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে দান সদকা করার বিষয়টি নিষিদ্ধ করে দেননি।
বুখারী ও নাসায়ী এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদকার কিছু বন্টন করছিলেন। এমন সময় জুল খুওয়াইসারা নামের এক ইহুদী এসে বলতে লাগলো- হে মোহাম্মদ, ইনসাফের সঙ্গে বন্টন করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মর্মাহত হয়ে বললেন- এ কেমন কথা! আমি যদি ইনসাফের সঙ্গে বন্টন না করি, তাহলে আর কে ইনসাফের সঙ্গে বন্টন করবে? এরপরও অমুসলিমদেরকে দান করতে তিনি নিষেধ করে যাননি।
সুরা আল মুমতাহিনার ০৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অমুসলিমদের প্রতি (যারা যুদ্ধে জড়ায়নি বা মুসলিমদের বের করে দেয়নি) অনুগ্রহ ও ইনসাফ করতে তাকীদ দিয়েছেন। এ আয়াতের বেসিক দুই শব্দ “তাবাররু” ও “তুক্বসিতু” অনেক ওয়াইড মিনি়ং প্রদান করে। করোনা সংকটের এ সময়ে বিপদগ্রস্ত অমুসলিমদের এসেনশিয়াল গুডস দিয়ে হেল্প করাটাও তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও ইনসাফের একটি মডেল হতে পারে।
সুরা মায়িদার ০২ নং আয়াতে সৎকর্ম (আল বিররু) ও তাকওয়ায় একে অপরকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘আল বিররু’ শব্দটি ইউজ করেছেন। ‘আল বিররু’ শব্দটি ভাস্ট মীনিং প্রদান করে। ‘আল বিররু’ শব্দটি দান-সাদকাকেও ইনক্লুড করে, অনেক জামহুর আলেম এমন অপিনিয়ন দিয়েছেন।
সুনানে আবু দাউদের ৩০৫২ নং হাদীসে এসেছে কোনো অমুসলিম এর অধিকার খর্ব করলে; তাকে কষ্ট দিলে অথবা তার কোনো কিছু ছিনিয়ে নিলে, রাসুলুল্লাহ সা. কিয়ামতের দিন অমুসলিমের পক্ষ হতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করবেন।
করোনা সংকটের এ সময়ে আমাদের প্রত্যেকের উচিত সাধ্যমত মুসলিম-অমুসলিম সকলের পাশে দাঁড়ানো। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের উদার নীতি নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়নের পাশাপাশি এর প্রচার-প্রসারে দান-সাদকা অব্যাহত রাখার তাওফিক দান করুন।
লেখকঃ সহকারি জজ, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।