নুরন্নবী সবুজ
প্রত্যেকটি আইন তৈরী করা হয় অন্যায় দূর করতে, সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠায় । আমাদের মানা না মানা ও ব্যাক্তি সচেতনতা ও ব্যক্তি বিবেকের অভাবে আইন থাকা সত্ত্বেও তার থেকে যে সুফল আসার কথা তা আসে না। ধর্ষণ আমাদের সমাজে একটি খুবই ঘৃণিত কাজে পরিণত হয়েছে । আজ আইনে ধর্ষণ নিয়ে যে আলোচনা তা জানার প্রচেষ্টা করবো। আমরা যদি স্বাভাবিক ভাবে বলি তাহলে কোন মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা জোর করে যৌন সম্পর্ক করলে তা ধর্ষণ। এটি আমাদের স্বাভাবিক ধারণা হলেও আইনে এই বিষয়কে আরো বাস্তবমুখী করে উপস্থাপন করা হয়েছে ও তার জন্য নানা মাপকাঠি উল্লেখ করা হয়েছে।
দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ৫ টি কারন দেখানো হয়েছে যে কারনগুলোর এক বা একাধিক কারন বিদ্যমান থাকলে তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়বে।
১. তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কোন মেয়ে যদি সম্মতি দেয় তাহলে তার সাথে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণের পর্যায়ে নাও পড়তে পারে। তবে এক্ষেত্রে বয়স ও পরকিয়ার বিধান মনে রাখতে হবে। আর কোন মেয়ের যদি যৌন সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছা না থাকে তাহলে তা সব ক্ষেত্রেই ধর্ষণের পর্যায়ে পড়তে পারে।
২. তার বিনা সম্মতিতে। আপনার যে নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার বৈধতা আছে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে যদি আপনি তার সম্মতি না নেন তাহলেও তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়তে পারে।যেমন, কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর বিনা সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক করেন ।
৩. সম্মতি নেয়া হয়েছে কিন্তু তা ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোন অস্বাভাবিক উপায়ে। আদালতে যদি প্রমাণ হয় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে, ভয় দেখানো হয়েছে তাহলে তাতে সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়তে পারে। অর্থ্যাৎ যৌন সম্পর্ক সব সময় স্বতঃস্ফূর্ত হবার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
৪. যার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে তার সম্মতি আছে কিন্তু নারীটি পুরুষের সাথে যৈন সম্পর্ক করে পুরুষটিকে তার স্বামী ভেবে। কোন পুরুষ যদি এমন প্রতারণা করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে সেখানে সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে পুরুষটি জানবে সে যার সাথে আছে সে তার স্ত্রী নয় ও সে মেয়েটি তার পরিচয় নিশ্চিত না হয়েই এ কাজটি করছে।
৫. মেয়ের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হলেও তা যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণের পর্যায়ে পড়তে পারে। তবে এক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ১৪ বছরের কম হতে হবে। কোন মেয়ে ১৪ বছরের কম হলে ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে সম্মতি দিলে তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়বে। আরো সহজ করে বললে কোন মেয়ে ১৪ বছরের বেশী হলে সে সম্মতি দিয়ে বৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর বিধান এখন প্রযোজ্য হবে। এই ধারায় একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যৈন সম্পর্ক স্থাপনে যৌনাঙ্গ প্রবিষ্ট করণই ধর্ষণ প্রমাণের জন্য যতেষ্ট হবে। এই ধারার ব্যাতিক্রমে বলা হয়েছে তের বছরের নিচে কোন মেয়ের সাথে যদি কোন স্বামী যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। তবে কোন স্ত্রীর যদি ১৩ বছরের বেশী বয়স হয় তাহলে তার স্বামী তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। আলোচানায় দেখলাম স্বামীও তার স্ত্রীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হতে। প্রথমত সে যদি তার স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এখানে আইন যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রীর যেন মর্যাদা ঠিক রাখা হয় তার জন্য এব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘ আরো একটি কারনে স্বামী তার স্ত্রীকে ধর্ষনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। আমরা ব্যতিক্রমে দেখেছি স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। ১৩ বছরের নিচে হলে ও স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক করলে তা ধর্ষণ হবে।কোন স্ত্রীর বয়স তের বয়সের হলে বা তার বেশী হলে যৌন সম্পর্ক স্থাপন আর ধর্ষণের পর্যায়ে পড়বে না।
আবার ৩৭৫(৫) ধারায় দেখতে পাই কোন মেয়ে ১৪ বছরের নিচে হলে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ হবে । সে সম্মতি দিলেও আবার না দিলেও । এই ব্যাখ্যা এবং ৩৭৫(১) একত্রে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় কোন মেয়ে যদি ১৪ বছরের উপরে হয় আর তার যৈন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি থাকে তাহলে সে সম্পর্ক ধর্ষণের পর্যায়ে নাও পড়তে পারে।
ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে ৩৭৬ ধারায় বলা হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধর্ষণকারীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। এর পাশাপশি আদালত অর্থ দন্ডও দিতে পারে। যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যৈন সম্পর্ক করে ও তার বয়স ১২ বছরের কম হয় তাহলে তিনি ২ বছরের কারাদন্ড অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-ধর্ষণ সমন্ধে আরো আলোচনা করা হয়েছে। ৯ ধারা যেখানে ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি সমন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন ৷ ব্যাখ্যা৷- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত 1[ষোল বৎসরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা 2[ষোল বৎসরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন ৷
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে- (ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন; (খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন ৷
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন ৷
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ৩ ধারায় বলা হয়েছে, আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর থাকিবে ৷ আর তাই ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো এই আইনে আলোচনা করা হয়েছে তা এই আইন অনুযায়ীই আদালত গ্রহণ করবে। আর অন্যান্য ক্ষেত্রে দন্ডবিধির বিধান প্রযোজ্য হবে। যেমন, এখানে ১৬ বছর বয়সের কম হলে তার সম্মতি থাক বা না থাক তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।আর এই বয়স দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ১৪ বছর দেখানো হয়েছে ।
তাই ২০০০ সালের পর থেকে ১৪ বছরের স্থানে ১৬ বছর পড়তে হবে। আবার ধর্ষণের চেষ্টা করলে বা পুলিশের হেফাজতে ধর্ষণ হলে তার বিধানও এখানে রাখা হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে অনেক বিধানকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এ আরো যুগোপযুগী করেছে। সমাজে নারীর প্রতি এই অমানবিক কাজগুলো শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই নির্মূল করা সম্ভব নয় । ব্যাক্তি যদি তার বিবেকের জায়গায় আরো দৃঢ় আর সচেতন হয় তাহলে আইন ও ব্যক্তি সচেতনতা সমাজ থেকে এ অপকর্ম দূর করতে সহায়তা করবে।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। mdnurunnobiislam379@gmail.com