মোঃ আল আমিন প্রধান
আজ মনটা বিষন্নতায় ভরপূর। দিনকে দিন এই বিষদাহ বেড়েই চলেছে। গত চার দিনে বাংলাদেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্য যথাক্রমে ৯, ১৮, ৩৫ ও ৪১ জন !নিঃসন্দেহে আক্রান্তের এই সংখ্যা জ্যামেতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বেঁচে থাকবো কী-না আমি নিজেই সন্দিহান ! পৃথিবী কী তাহলে নবরূপে আবির্ভূত হচ্ছে ?পরিবর্তন হবে কী ভূ-রাজনীতিরু ? পরাশক্তির পরিবর্তনের কোন আভাস নয়তো ? নাকিবুঝাতে চাচ্ছে – পৃথিবীতে কেউ কারো নয়- মাঝখানে যা হয়ে থাকে তা শুধুই সম্পর্কের এক ছলনাময় খেলা ! তা না হলে, অর্থনীতির চাপে বসে যাচ্ছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল দেশটিও অথবা আজকের এই দূর্দিনে মানুষ কেন তার আপনজনের কাছেও আসছে না ?হয়তো আরো অনেক প্রশ্ন থেকে যায়, তবো আমরা কেন সচেতন নই, কেন দায়িত্ব এড়িয়ে যাই।
বৈশ্বিক এই যুদ্ধে ডাক্তারগনের ভূমিকা সমর নায়কদের মতোই । ডাক্তারগন সবসময় পূজনীয় কারন তাদের পেশার ধর্মই হলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও অন্যকে সারিয়ে তুলা । আমরা সবাই জানি অন্যান্য দেশের ডাক্তারগণ তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে করোনা চিকিৎসায় মনোনিবেশ করেছেন, কয়েকজন এই মহৎ কাজে জীবন ও বিলীয়ে দিয়েছেন , তাঁরা মারা যাননি, বেঁচে আছেন বিশ্বের সকল মানব হৃদয়ে মহা নায়ক হয়ে ।
বেশি করে মনে পড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যারা দেশকে ও দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য শত্রæর বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন, আজকের এই মহা দূর্দিনে সত্যিই তাদের কথা বেশি করে মনে হচ্ছে, অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতে মন কাঁদছে ,এই মানুষদেরকেই আজ খুব প্রয়োজন ! হয়তো হুবহু তাঁদের পাবো না , কিন্তু তাঁদের মানসিকতার মানুষদের বড়ই প্রয়োজন , আমরা অনেকেই অনেক বুলি আউড়াই – মুক্তিযোদ্ধের সময় আমি থাকলে আমিও যুদ্ধে যেতাম , জীবন দিয়ে দিতাম দেশের জন্য , দেশের মানুষদের জন্য ইত্যাদি- ইত্যাদি। তখন তো শত্রæর তাক্ করা ব্ন্দুকের সামনে যেয়ে মুখোমুখি যুদ্ধ ও করতে হয়েছে। আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বিবীত, তখনকার চেয়ে এখনকার আমরা তারুণ্যে – শক্তিতে আর সংখ্যায় অনেক বেশি কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের মতো দেশের তরে জীবন দিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কী আমাদের আছে ? সামন্য দায়িত্বটুকুও আমরা এড়িয়ে যাই , এমনকি ভয়ে নাকি সাধারন রোগীদেরও গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না কিছু কিছু ডাক্তার আর নার্স ! কতটুকু কষ্ট পেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সুরে বলেন যারা এই দূর্দিনে শর্ত দিয়ে কাজ করতে চান তাদের কোন প্রয়োজন নেই , প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ডাক্তার নিয়ে এসে এদেশের মানুষদের চিকিৎসা করাবেন !
আমাদের ২ টি প্রধান দূর্দিন তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দূর্দিন ছিলো ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযোদ্ধ যেখানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী কারাগাড়ে তাঁর জন্য কবর খোড়া হয়েছিলো কিন্তু তিনি ভয় পাননি , কোন আপোষ করেননি , বরংচ বলেছিলেন – আমার লাসটি দেশে পাঠিয়ে দিয়ো ! আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি আর বড় বড় ডাক্তার, অফিসার হয়েছি , কিন্তু চিন্তা করেন তো যদি দেশটি স্বাধীন না হতো তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অফিসের কেরানী হতে পারতাম কী-না ? আর আরেকটি দূদির্নে বর্তমানে চলছে , আর এই দিনে হয়তো বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসুরী তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন , তিনি বার বার বলছেন আমরা যেন ,ঘরে থাকি, আমরা যেন ঠিক মতো চিকিৎসা দেই , আমরা যেন হত দরিদ্র আর নিম্ন বৃত্ত-নিম্ন-মধ্যবৃত্তের চাল চুরি না করি ! পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, মাঠ প্রশাসন, ডাক্তারসহ করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতদের জন্য স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন, ৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা সহ অসহায় মানুষদের লকডাউন এর দীর্ঘ সময়ে খাবার এর ব্যবস্থা করছেন । কয়েকটি সংবাদে আসলো স্থানীয় প্রশাসনের দুই এক জন এখানেও দূর্ণিতী করতে চাচ্ছে যার কারণে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারী সহ খাবার বন্টনের দায়িত্ব সশস্র বাহিনীর হাতে দিয়েছেন।
বিদেশে অনেক ডাক্তার পিপিই না থাকায় পলিথিন গায়ে দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে যাচ্ছেন , আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রোগীর সেবার জন্য তাঁর পূর্ব পেশা ডাক্তারিতে চলে আসছেন আরো কতো মহৎ নজির আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখছি , তাহলে আমরা কেন আমার দেশের প্রিয় মানুষদের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছি ? তবে চলেন আমরা যুদ্ধে শরীক হই। এ যুদ্ধ শত্রæর বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়া নয়, এ যুদ্ধ মানবিকদতার আর বুদ্ধিদিপ্ত ও ধৈর্য্যশীল মানসিকতার । এ যুদ্ধের সর্বাগ্রে থাকবেন সম্মানিত ডাক্তারগন, সাথে থাকবো আমরা সবাই।
কিন্তু বিষণকষ্ট পাই যখন শুনি মানব-প্রেমিক সেই ডাক্তারগনের কয়েকজন করোনার ভয়ে অন্যান্য অসুস্থ রোগীকেই গ্রহণ না করে নানাধরনের হয়রাণীর মাধ্যমে স্বাভাবিক রোগীকে অস্বাভাবিক করে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেন । সংবাদ মাধ্যমে হয়তো তার কয়েকটি মাত্র প্রকাশ পায় , অন্যান্য অগণিত অসহায় মানুষদের স্বজন হারাণোর খবর হয়তো অন্তরালেই থেকে যায় !প্রতিদিনের মতো আজ ও খবর আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় ছোট ভাই সদা হাস্যোজ্জ্বল সুমন চাকমা মারা গেলেন ডাক্তারগণের অবহেলায় ! তার করোনা হয়নি যা সে স্টেটাসে ও দিয়েছিলো এবং সে এই ব্যাপারটাই ভয় পেয়েছিলো যে করোনা আতঙ্কের কারনে ডাক্তারগণের অবহেলায় হয়তো মারা যাবো , তার ভবিষ্যৎদ্বানী ঠিক ছিলো ! ডাক্তারগনের কয়েকজন করোনাতঙ্কে সাধারণ রোগীদের ও গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না! সুমন তাদেরই অবহেলার শিকার।
বৈশ্বিক এই দূর্দিনে দেশের সেবায় মনোনিবেশ করে ডাক্তারগনের যেমন জাতীয় বীর হবার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে যেটা হয়তো পারেননি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযোদ্ধে । তেমনি রোগীদের অবজ্ঞা আর অবহেলা করে উল্টোটা হওয়ারও ভয় আছে । সংসারের সবচেয়ে সেবা পরায়ণ আর ব্রিলিয়ান্ট ছেলে-মেয়ে গুলোর অধিকাংশই এই পেশায় আসেন , তাঁরা সবাই মহৎ কাজ করবেন সেটাই আমরা মনে করি। কিছু খারাপ কাজ ১৯৭১ ও হয়েছিলো এখনো হবে, যাদের কেউ ভুলে নাই আর বাংলাদেশ যতদিন রবে জাতি যেমন বীর সেনাদের মনে রাখবেন তেমনি মনে রাখবেন রাজাকারদেরও। তবে আমরা আশাবাদী, মহান পেশার মহৎ লোকগুলো তাঁদের ভালো কাজের জন্য জাতির হৃদয়ে আজীবন থাকবেন।
অসহায় মানুষটি যে আপনাকেই এই পার্থিব জীবন সংসারে ঐ মূহুর্তের জন্য অত্যন্ত আপন ভাবেন, সে মানুষটি তার স্ত্রী-সন্তান , বাবা-মা, ভাই-বোন আর নিকট আতœীয়ের চেয়ে যে আপনাকেই বেশি নির্ভরশীল আর ভালোবাসার মানুষ ভাবেন। সে হয়তো আপনার একটু ভালোবাসা পাবার আশায় অত্যন্ত ক্ষুদাতূর ! আমরা অনেকেই জানি রোগীদের সাথে আপনার সুন্দর ব্যবহার তার ৫০% রোগ ভালো করে তুলে। আজকের এই যুদ্ধে আপনারা সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দিবেন জীবন নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচার, সৃষ্টিকর্তার পর আপনাদের কাছেই আমরা ভরসা পাবো ,স্বপ্ন দেখবো, যদি মারাও যাই তাও হাসতে হাসতে হয়তো মৃত্যুকে বরণ করে নেবো এই ভেবে যে পৃথিবীতে কেউ হয়তো আমাদের জন্য আছেন।
সরকারের স্বাস্থ বিভাগ, প্রসাশন,সশস্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, কাস্টমস, ও ব্যাংক সহ অনেক ডিপার্টমেন্ট নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। প্রিয় ডাক্তারগণের উদ্যেশ্যে বলছিসশস্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা – সারাদিন রাস্তায় থাকছেন আমাদের ঘরে নিরাপদ রাখার জন্য, বাংলাদেশ কাস্টমস বিভিন্ন বন্দর গুলোতে জরুরী আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছে যেখানে তাঁদের নিজেদের জীবন রয়েছে অনেক ঝুঁকির মধ্যে , এরা সবাই আপনার – আমার করোনা মুক্ত সুন্দর সকাল উপহার দেওয়ার জন্য এত কষ্ট করছেন।
আমরা বিদেশ-ফেরত রেমিটেন্স আর্নারদের নানাভাবে কটাক্ষ করছি, তাঁরা না আসলে নাকি করোনা হতোই না , কিন্তু বিদেশ থেকে বিদেশীরাসহ অনেক পণ্যই দেশে আসে , এই দুই মাধ্যমেও তো ভাইরাসটি আসতে পারে , চিন্তা করেছি কখনো ? আমাদের বেকার জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বিদেশে শ্রমবাজার দখল করে আছেন যারা দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখে আসছেন। বৈশ্বিক এই বিপদে মা-বাবা যেমন তাঁর ছেলে-মেয়েকে কাছে চান তেমনি তাঁরাও অনেকে চান দেশের মাটিতে এসে মা-বাবা ও আপনজনের কাছে থাকতে, দেশের মাটিতে প্রিয়জনদের কাছে মরেও শান্তি পাবে বলে। অনেকে বুদ্ধি করে আসেন নি, তাঁরা হয়তো আবেগ নিয়ন্ত্রন করেছেন সামষ্টিক স্বার্থের জন্য । সবাইকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তবে যারা চলে আসছেন তাঁদের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও ভালোবাসা বিনিময় করা যায় । তাঁদের ও দায়িত্ব সরকারের দেওয়া সকল আইন কানুন সম্মানের সাথে মান্য করা।
আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রন করে ঘরে থাকতে হবে, গুজবে কান দেওয়া যাবে না, সরকারের দেওয়া সকল বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে, হতে হবে আরো বেশি মানবিক , দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ও হতে হবে অনেক বেশি দায়িত্বশীল। গার্মেন্টস কর্মীদের যথাযত সম্মান দিতে হবে,তাদের সাথে যা হয়েছে তা কোন দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করিনাই ! এই কর্মকান্ডে শুধু গার্মেন্টস কর্মীরাই ভয়ে নেই ভয়ে আছি দায়িত্বশীল যারা আছেন তাঁরা সহ আমরা সবাই। সর্বোপরি, কয়েকটা দিনের জন্য নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে হলেও ঘরে থাকতে হবে । প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করি – নিজে বাঁচি আর প্রিয় দেশটাকে বাচাই।
লেখকঃ মোঃ আল আমিন প্রধান শুল্ক কর্মকর্তা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড