নুরন্নবী সবুজ
আপনি যদি বেচে না থাকেন তাহলে মরার পরে আপনার আইনী প্রতিকার থাকলেই কি বা না থাকলেই কি? আপনার যদি কোন ক্ষতি সাধিত হয় তাহলে ক্ষতি সাধনের পর তার পুরো ক্ষতিপূরণ হয়ত পূরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। আবার কোন অপরাধ বা নেতিবাচক কাজ করার পর তার শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য অনেক তথ্য প্রমাণ সময় এবং অর্থের প্রয়োজন । এই কারনে অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আদালতে বিচার নিয়ে যেতে চায় না। আদালত অনেকের কাছেই একটি আতঙ্কের নাম। জনগণের জন্যই সকল আইন এবং তার বিধি বিধান তৈরী । জনগণের পক্ষে বিভিন্ন ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যাক্তিবর্গ তার ব্যবহার করে থাকে মাত্র।
প্রত্যেক মানুষের জীবন ও মাল রক্ষা করার দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের । তবুও রাষ্ট্র তো জনগণের জন্য তৈরী আর তাই সমাজে যখন কিছু মানুষ সামষ্টিক ক্ষতির কারন হয় আর তার প্রতিকারের জন্য তাৎক্ষণিক কোন ব্যাবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না তখন ব্যাক্তি তার নিজের স্বার্থে সমাজের স্বার্থে কিছু কাজ করতে পারে। আর এই কাজগুলো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অপরাধ হলেও তখন প্রমাণ সাপেক্ষে তা অপরাধ নাও হতে পারে। পরিস্থিতির স্বিকার হয়ে যখন একজন মানুষ নিজের প্রতিরক্ষার জন্য বা সম্পত্তির প্রতি রক্ষার জন্য কোন কাজ করে তাকে আত্মরক্ষার অধিকার বলা হয় । আর এই আত্মরক্ষার অধিকার অধিকার প্রয়োগ কালে কাউকে হত্যাও অপরাধ নয়।আর কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধ নয় তা আইনেই বলা আছে।
সহজ কথায় আত্মরক্ষার (দন্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৯৭ ধারা ) অধিকার দুই রকম বা আমরা দুইটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি, ১. দেহের আত্মরক্ষার অধিকার ২. সম্পত্তি রক্ষার অধিকার দেহের আত্মরক্ষার অধিকার: আপনাকে কেউ আঘাত করতে আসলো। আপনি শুধু মার খেয়ে গেলেন । বা আপনি বুঝতে পারলেন যে আপনাকে মেরে ফেলা হবে আপনি তার পরেও কি চুপ থাকবেন। নিশ্চয়ই না। আপনার উপর আঘাত করতে আসলে আপনি নিজের সুরক্ষার জন্য তাকেও আঘাত করতে পারবেন। তবে শর্ত হলো সে ব্যক্তি আপনার যতটুকু ক্ষতি করতে পারে ততটুকু প্রতিরক্ষার অধিকার আপনার থাকবে।
আপনি আপনার যে সম্ভাব্য ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশ আঘাত বা ক্ষতি গ্রহণ যোগ্য নয়( দন্ডবিধি , ১৮৬০ এর ৯৯ ধারা ) আবার আপনাকে যখন এরূপ ক্ষতি বা আঘাত করার চেষ্টা করা হবে শুধুমাত্র তখনই এটি বজায় থাকবে। আক্রমণের ভয় দূর হয়ে গেলে আপনি আর আক্রমণ করতে পারবেন না। আপনাকে আক্রমণ করলো এক সময় আর আপনি অন্য সময় তাকে আক্রমণ করে এর সুবিধা নিবেন আইনে তার সুযোগ নাই (দন্ডবিধি , ১৮৬০ এর ধারা ১০৫ )। আপনাকে রাস্তায় কোন ছিনতাইকারী আটক করলো । তারা আপনার গলায় ছুড়ি ধরে সব জিনিসপত্র চাইলো। আপনি যদি না দেন তাহলে তারা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় আপনি নিজের রক্ষার জন্য সে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটাতে পারবেন। আর সে ব্যক্তি যদি আপনাকে এসে এলোপাথারি মারতে শুরু করে তাহলে আপনার আত্মরক্ষার অধিকার শুধুমাত্র মারামারির মধ্যেই সীমিত থাকবে। এর বেশী যেতে পারবেন না।
আবার দেখা গেল আপনি একবার ছিনতাই কারীর কবলে পড়ে অন্য সময় লোক জমায়েত করে তাদের মারধর করলেন ।এক্ষেত্রে আপনি এ বিশেষ সুবিধা পাবার উপযুক্ত হতে পারবেন না। আপনি যদি তাকে সেই বিশেষ সময়ের পর আঘাত করেন তাহলেও এ সুবিধা আপনার জন্য না। আপনি যদি আগে থেকেই আসামী হোন তাহলে আপনাকে কতৃপক্ষ শাস্তি দিতে পারে। বা কোন ব্যক্তি আপনার উপর চাপ সৃষ্টি করার অধিকার রাখে তাহলে সে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে । আপনি এ বিষয়ে কিছু করতে পারবেন না। পুলিশ প্রশাসন বা কোন কাজ করার জন্য কোন কতৃপক্ষ যদি তার আইনগত দ্বায়িত্ব পালন করে তাহলেও আত্মরক্ষার এ অধিকার পাওয়া যাবে না। তবে সেটা যদি ক্ষমতা বহিভূৎ অসৎ উদ্দেশ্যে হয় তাহলে আপনার আত্মরক্ষার এ অধিকার বজায় থাকবে।
আবার সে কর্মচারী যদি কোন ক্ষমতা না পেয়ে কাজ করে বা সে যে সরকারী কাজ করতে এসেছে তা প্রকাশ না থাকে তাহলেও প্রতিরক্ষার অধিকার বজায় থাকবে দন্ডবিধি , ১৮৬০ এর ৯৯ ধারা) । আপনাকে বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে আত্মরক্ষার অধিকার ভোগ করা ক্ষেত্রে আপনার যতটুকু ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে আপনি ততটুকুই শুধুমাত্র রক্ষা করতে পারবেন । তার বেশী করলে ।
আদালত আপনাকে ছাড় নাও দিতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে মুত্য ঘটানো যাবে তা দন্ডবিধি , ১৮৬০ এর ১০০ ধারায় বলা হয়েছে।
ক. তার আচরণ দেখে বা আক্রমণের ধরন দেখে যদি আপনার মনে হয় আপনার মৃত্যু ঘটবে। যেমন কোন ব্যক্তি আপনার দিকে বন্দুক তাক করেছে গুলি করার জন্য। এমন অবস্থায় আপনি যদি তা প্রতিহত না করেন তাহলে তো আপনার মৃত্যু হতে পারে । এমন অবস্থায় আপনাকে রক্ষার জন্য মৃত্যু ঘটাতে পারেন।
খ. আপনার গুরুতর আঘাত বা জখম হবার ভয় থাকে। গুরুতর জখম বা আঘাত কোন গুলো তা দন্ডবিধির ৩২০ ধারায় বলা হয়েছে। এখানে মূলত ৮ প্রকার জখম দেখানো হয়েছে, ১. পুরুষত্বহানী করা ২. স্থায়ীভাবে কোন চোখের ক্ষতি করা ৩. স্থায়ীভাবে যে কোন কানের শ্রবণ শক্তি নষ্ট করা ৪. যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির ক্ষতি সাধন ৫. যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির শক্তি ধ্বংস বা স্থায়ী ক্ষতির চেষ্টা করা ৬. মুখ বা মাথার স্থায়ী বিকৃতি করা ৭. যে কোন অস্থি বা দাত ভগ্ন বা গ্রন্থিচ্যুত করা ৮. এমন কোন আঘাত যার ফলে আপনাকে বিশ দিন দৈহিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে বা আপনাকে ২০ স্বাভাবিক কাজ কর্ম থেকে দূরে থাকতে হতে পারে। কাজগুলো গুরুতর জখম এবং কাজ গুলো যদি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা তৈরী হয় তাহলেও কারো মৃত্যু ঘটানো যেতে পারে।
গ. ধর্ষণের অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ । বর্তমান সময়ে মেয়দের জন্য ধর্ষণ একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ধর্ষণের পর যেমন আইনী প্রতিকার আছে তেমনি ধর্ষণের মুহূর্তেও আছে প্রতিকার । নিজের সম্মান বাচাতে কোন মেয়ে ধর্ষণের চেষ্টা কারীর মৃত্য ঘটাতে পারে।
ঘ. অপ্রকৃত কাম লালসার অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমন
ঙ. মানুষ অপহরণের চেষ্টা
চ. অবৈধভাবে আটকের অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে আপনি যদি আইনী প্রতিকার বা আইনের দ্বারস্থ হবার মত সময় ও সুযোগ থাকে তাহলে আপনি এ সুবিধা নাও পেতে পারেন। নিজেকে রক্ষা করার মাধ্যমে আমরা আইনের রক্ষা করতে পারি । আর আইনের রক্ষা করে আমরা সমাজে শান্তি বজায় রাখতে পারি।
সম্পত্তি রক্ষার অধিকার : নিজেকে কখন কখন রক্ষা করা যাবে আর সে ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটানো অপরাধ হবে কিনা তা যেমন আইনে উল্লেখে করা হয়েছে তেমনি সম্পত্তি রক্ষার খাতিরে কখন মৃত্যু ঘটানো যাবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১০৩ ধারায় ৪ টি ক্ষেত্রে সম্পত্তি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটানো যেতে পারে। ক. দস্যুতা। ( দস্যতা হলো চুরি বা বল প্রয়োগ করে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যদি কাউকে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হয় বা করা হয় , কাউকে আঘাত করা হয় বা আঘাত করার চেষ্টা করা হয় তাহলে তা দস্যুতা বলে গণ্য হবে- দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৯০ ধারা )
খ. রাত্রি বেলা অপথে গৃহে প্রবেশ। ( কোন ব্যাক্তি সূর্যাস্তের পর এবং সূর্যাদয়ের পূর্বে যদি সিধ কেটে বা দরজা জানালা ভেঙ্গে গৃহে প্রবেশ করে- দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪৪৬ ধারা )
গ. বাসগৃহ বা সম্পত্তি সংরক্ষণের স্থানে অগ্নি সংযোগ করা
ঘ. চুরি , ভীতি বা অনধিকার গৃহে প্রবেশের মাধ্যমে যখন মৃত্যু বা গুরুতর জখমের ভয় থাকে। আইনের কাজ সামাজিক শান্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে শান্তি নিশ্চিত করা । ব্যক্তিগত অধিকার ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক সুন্দর করতে না পারলে এই শান্তি আনা সম্ভব না ।
এ কারনেই শুধু বিচার বিভাগের উপর চাপ কমাতে ও প্রত্যেক মানুষকে সচেতন আর প্রতিবাদী করতে দন্ডবিধির এই বিধান গুলো খুব কাজে দিচ্ছে। তবে এই ক্ষেত্রে আপনাকে বিশেষ ভাবে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১০১ ও ১০৫ ধারার বিধান অনুসরণ করতে হবে। আপনি যে নির্দোষ তার তথ্য প্রমাণ আপনাকেই দিতে হবে আর তা যদি এই ব্যতিক্রমগুলোর মধ্যে পড়ে সেটাও আপনাকে উল্লেখ করতে হবে। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণে বা আদালতের কাছে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হবার মত পরিবেশ তৈরী হলেই কেবল আপনি মুক্ত থাকতে পারবেন। সমাজের স্বার্থে এই বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার কাম্য নয়।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট । mdnurunnobiislam379@gmail.com
মতামত লেখকের সম্পূণই ব্যক্তিগত