সব
facebook apsnews24.com
মিথ্যা ও হয়রানি মামলায় আইনগত প্রতিকার আছে কি - APSNews24.Com

মিথ্যা ও হয়রানি মামলায় আইনগত প্রতিকার আছে কি

মিথ্যা ও হয়রানি মামলায় আইনগত  প্রতিকার আছে কি

মিথ্যা ও হয়রানি মামলায় আইনগত  প্রতিকার আছে কি

কাল্পনিক মামলার ঘটনা । পাঠক পড়ে সার্থকতা লাভ করবে বলে মনে করছি। সামান্য তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে প্রতিবেশী রিনা আক্তার ও তার ভাইয়ের সঙ্গে কামাল কারিগর এর সাথে ঝগড়া হয়। ওই ঝগড়াঝাটির প্রকৃত ঘটনা বাদ রেখে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্প বানিয়ে ধান কাটা ও মারামারি ও চুরি চেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন দরখাস্তকারী রিনা আক্তার। আদালত বাদিনীর  জবানবন্দি গ্রহণান্তে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নিকটস্থ থানার ওসির ওপর তদন্ত দেন। ওসি তার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তদন্তকালে বাদিনীর অভিযোগে বর্ণিত ঘটনাটি অর্থাৎ রাত ৮.০০ টার সময় তাদের বাড়িতে কোনো প্রকারের ঘটনা ঘটেনি। আসামি কামাল কারিগর কর্তৃক বাদিনীকে ধানকাটা, চুরি ও মারামারি বা চেষ্টা করার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য, প্রমাণ, পারিপার্শ্বিকতা ও ঘটনাপ্রবাহে বাদিনীর আনীত দন্ডবিধির ৩২৩, ৩৭৯, ৩৫৪ ধারার অভিযোগ প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

উক্ত তথ্য জেনে বাদিনী আদালতে এসে তার নিযুক্ত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে এ ঘটনাটি দিয়ে আর কীভাবে কামালকে হয়রানি করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ করেন। সে মোতাবেক রিনা আক্তার ওসির তদন্ত প্রতিবেদন সত্য নয় মর্মে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। আসামি কামাল খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন দন্ডবিধির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব মামলার নারাজি পিটিশন মঞ্জুর করা হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, নারাজি আদালতে গৃহীত হলে বিচার প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবেশ করতে হবে। কথিত আসামি কামাল পরে আইনি ঝামেলা নিরসন করার লক্ষ্যে বাদিনী ও তার অবিভাবকের সঙ্গে মামলা তুলে নেয়ার বিষয়ে আলোচনায় বসেন। পরিশেষে কিছু পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বাদিনী ও আসামির সঙ্গে আপোষ মীমাংসা হয়। বাদীনি টাকা বুঝে পাওয়ার পর মামলা তুলে নিতে সম্মত হয়। বাদিনী পরবর্তী তারিখে আদালতে এসে বিচারকের সামনে দলখাস্ত দিয়ে বলেন, তার আসামির বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগ নেই। উভয়ের মধ্যে আপোষ হয়েছে। পূর্বের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছ। এভাবে কামাল তার, বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলা হতে অব্যাহতি পেল।

সারা দেশে ও সমাজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য তুচ্ছ ঘটনা ঘটছে আর এসব তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের হচ্ছে অহরহ মামলা যার বেশির ভাগই আবার মিথ্যা মামলা। সাধারনত উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে প্রতিপক্ষকে হয়রানী করার জন্য এধরনের মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে। এতে করে যার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক বানোয়াট মামলা দায়ের হয় তিনি যেমন মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন তেমনি হয়রানী ও মামনহানি ঘটে। বিভিন্ন আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলা, যৌতুকের মামলায় এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারার অধীন দায়েরকৃত মামলা গুলোর অধিকাংশ মিথ্যা ও হয়রানী মূলক উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।

যদি কোন ব্যক্তি এমন একটি মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলার শিকার হয় সেক্ষেত্রে করনীয় কি হবে? যদি আপনি জানতে পারেন থানায় আপনার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয় সেক্ষেত্রে এজাহারের কপি সংগ্রহ করে একজন আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। মামলাটি জামিন অযোগ্য হলে আদালতে জামিনের আবেদন করে জামিন নিয়ে আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। আর যদি এমন হয় আপনি মামলা সম্পর্কে অবগত নন সেক্ষেত্রে পুলিশ আপনাকে ওয়ারেন্ট এর মাধ্যমে গ্রেফতার (আইন অনুযায়ী বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট ছাড়ায় গ্রেফতার করতে পারে) করে থানায় নিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পুলিশ আপনাকে আপনার পছন্দমত একজনআইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে আইনগত ব্যবস্থা নেবার সুযোগ দিবেনএবংএক্ষেত্রে ও মামলাটি জামিন অযোগ্য হলে জামিনের ব্যবস্থা করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবেআর যদি কোর্টে মামলা দায়ের হয় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মামলার প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ীসমনবাওয়ারেন্টইস্যু করবেন। এক্ষেত্রে ও আপনাকে আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।     

আইনগত প্রতিকার কি? আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে যিনি মামলা দায়ের করেছেন তিনিই সাক্ষ্য প্রমানের মাধ্যমে আপনার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা প্রমান করবেন। অনেক সময় মিথ্যা মামলা হলে মামলাকারী মামলা ঠুকে দেওয়ার পর আদালতে হাজির হন না। এক্ষেত্রে কয়েকটি তারিখ যাওয়ার পর মামলা থেকে খালাস পাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ আইনে রয়েছে। মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে আপনি মিথ্যা মামলায় হয়রানি করার জন্য ফৌজদারি মামলা বা দেওয়ানী মোকাদ্দমা দায়ের করতে পারেন। মিথ্যা মামলা সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধি এবং দণ্ড বিধিতে শাস্তির বিধান রয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামালার শাস্তির বিধান রয়ছে। ২৫০ ধারা অনুযায়ী, “ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামীকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানী মূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ  দিতে পারেন”।

দণ্ডবিধির ২০৯ ধারামতে, “মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে”। আবার মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তি বলা হয়েছে দণ্ডবিধির ২১১ নং ধারায়, “যদি কোন ব্যক্তি কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করে তবে মামলা দায়েরকারীকে দুইবছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং যদি এই ধরনের ফৌজদারি কার্যধারা মৃত্যুদণ্ড যুক্ত অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে, [যাবজ্জীবন কারাদণ্ড], বা সাত বছর বা তার চেয়ে বেশি কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারে, তবে তার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং জরিমানার জন্য ও দায়ী হবে।

দণ্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে।

দণ্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা আছে যে ব্যক্তি আইনত শপথের দ্বারা বা সত্য প্রকাশের জন্য আইনের প্রকাশিত বিধান দ্বারা আবদ্ধ, বা যে কোন ও বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার জন্য আইনের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে যে কোন ও বিবৃতি মিথ্যা, এবং যাতে নিজেকে বা মিথ্যা বলে বিশ্বাস করেন বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, বলা হয় মিথ্যা প্রমাণদেয়। কোন বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোন ভাবে দেওয়া হোক না কেন তা এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “যদি কোন ব্যক্তি কোন বিচার বিভাগীয় মোকদ্দমায় কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে  সেই ব্যক্তির যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ড-যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে- দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে,  যদি অন্য কোন মামলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।

মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য মৃত্যুদণ্ড শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ১৯৪ ধারা অনুযায়ী, “যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য  দেওয়া বা উদ্ভাবন করা যার উপর ভিত্তি করে নির্দোষী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে, যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া যাবে”। এছাড়া ও দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১, ৫০২ ধারায় (অপরাধের ধরন অনুযায়ী) ফৌজদারি মামলা করে দুই বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে।

আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭ ধারায় ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থ দণ্ডে ও দণ্ডিত হবেন। অথবা আপনি চাইলে দেওয়ানী মোকাদ্দমা দায়ের করে আর্থিক ক্ষতি পূরণ চাইতে পারেন। আইনের যথার্থ প্রয়োগ হোক অপরাধীর বিরুদ্ধে, কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হোক এটাই সবার প্রত্যাশা। আইনের একটি বহুল প্রচলিত কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, হাজার খানেক অপরাধি বেকসুর খালাস পাক, কিন্তু একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিও যেন সাজা না পায় সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

করোনার দুঃসময়ে এ বিষয়ে ভাবনার সময় এসেছে যে, করোনা ভাইরাস আসার আগে যারা মিথ্যা মামলা বা কাউকে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা কেস দায়ের করেছিলেন তাদের উচিত হবে ওই মিথ্যা ও বানোয়াট কেস-মামলা গুলো নিজ দায়িত্বে তুলে নেয়া। মিথ্যা কসম খাওয়া, দোষারোপ করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ধর্মের বিধান মতে কঠিন গুনাহ আর এসব কারণে নানা গজব ও মহামারি দেখা দেয়। সামনে সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভু যদি আমাদের সকলেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে তওবা করবো এবং বেশি বেশি করে ক্ষমা প্রার্থনা করবো।

লেখকঃ আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট। ইমেল- bdjdj1984du@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষুধার্ত মানুষ ও আমাদের তামাশা!

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষুধার্ত মানুষ ও আমাদের তামাশা!

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj