“ইনজাস্টিস এনিহোয়ার ইজ আ থ্রেট টু জাস্টিস এভরিহোয়ার” অর্থাৎ “একটি সমাজের যেকোনো স্থানে অবিচার সর্বত্রই ন্যায় বিচারের জন্য হুমকি”। নোবেল বিজয়ী মার্টিন লুথার কিং এর এই বিখ্যাত উক্তিটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটু ঘুরিয়ে বললেই মনে হয় ভালো শোনাবে – সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিব কোথা!
আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললেই “অমুক জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে একজনকে হত্যা”, “তমুক জায়গায় গ্রাম্য সালিশে জনপ্রতিনিধি কর্তৃক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে বেধড়ক পিটুনি” টাইপি শিরোনামে সংবাদ চোখে পড়ে। সম্প্রতি গত ২১ শে আগস্ট কক্সবাজার চকরিয়া উপজেলার হারংবর ইউনিয়নের এরকম একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে দেশব্যাপী অনলাইন প্রতিবাদের ঝড় উঠে। পত্রপত্রিকাগুলোতে “গরু চোর অপবাদ দিয়ে মা-মেয়েকে রশিতে বেঁধে নির্যাতন” শিরোনামে সংবাদ ছাপানো হয়। গত জুলাই মাসে খুলনার মশিয়ালিতে স্থানীয় নেতার লোকেরা গুলি করে তিনজনকে মেরে ফেলে, সঙ্গে গণপিটুনিতে মারা যায় আরো একজন। সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা নেহাৎ ই কম নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল না হওয়া কতশত এরকম ঘটনা আমাদের অজানাই থেকে যাচ্ছে তার হিসাবটা জানা নাই।
আমাদের বিচার বিভাগে পর্যাপ্ত বিচারকের অভাব তথা জনবল সংকট, বিধিবদ্ধ আইনের জটিলতা এবং মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে পর্যাপ্ত মামলা নিষ্পত্তি করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না আমাদের আদালতগুলো। সুপ্রিমকোর্টের হিসেব বলছে ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় ৩০ লাখ মামলা ঝুলে আছে এবং এই সংখ্যা দিনদিন ক্রমশই বাড়ছে। আদালত পাড়ার এতসব প্যাঁচকলের সাথে অসাধু দালালদের দ্বারা হয়রানি সহ নানা কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষ খুব সহজে সেখানে যেতে চায় না। এর বদলে তুলনামূলক সহজলভ্য গ্রাম আদালতের শরণাপন্ন হয় সাধারণ মানুষ। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মোটা অংকের মামলা নিষ্পত্তি করে অবদান রাখে স্থানীয় সরকারের এই গ্রাম আদালত গুলো।
“গ্রাম আদালত আইন -২০১৩” (সংশোধিত) অনুযায়ী গ্রাম আদালত গুলোর সালিশ পরিচালনা হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুব একটা মানা হয় না। এমনকি গ্রাম আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা যেমন হত্যা,খুন বা ধর্ষণ মামলার নিষ্পত্তিও করতে দেখা যায় সেখানে। এসব আদালত পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাওয়ার কারণে খেয়ালখুশিমতো নিজেদের স্বার্থে সালিশ কে প্রভাবিত করে অনেকক্ষেত্রেই। এবং ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে নজির স্থাপন করে।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, গ্রাম্য সালিশের আদালতে বিচারের নামে অবিচার কিংবা কাজের লোকের উপর নির্যাতন অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূত যেকোনো ধরনের শাস্তি প্রদানের মতো ঘটনা গুলো আমাদের দায়িত্বশীল মানবসত্তার নীতিগত পদস্খলনের সংকেত প্রদান করে । সেইসাথে জাতীয় দুরবস্থার আঞ্চলিক দৃশ্যায়ন ও বটে।
আদিম যুগের গুহায় পাহাড়ে বা জঙ্গলে বাস করা মানুষ থেকে আজকের পৃথিবীতে এক ঘন্টায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা মানুষের জীবন যাপনে আকাশছোঁয়া পরিবর্তন এসেছে। সভ্যতার বিবর্তনে সমাজ কাঠামোর যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনই পরিবর্তন এসেছে অপরাধের ধরনেও। ক্রমান্বয়ে অপরাধ প্রবণতায় যুক্ত হচ্ছে হিংস্রতা, বীভৎসতা ইত্যাদি। একই অপরাধ বারবার নির্দ্বিধায় সংঘটনের সুযোগ পাওয়ায় সামাজিক সংবেদ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ব্যক্তির চেতনা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কেবল নিজের এবং আত্মীয়-স্বজনদের নিরাপত্তাকে ঘিরে। ফলে পুরো সমাজ ব্যবস্থায় আত্ননিরাপত্তা ও আত্মকেন্দ্রিকতা সুস্পষ্ট হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। মানবিক অন্যায় কিংবা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
কোন সমাজ যখন প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায় তখন রাষ্ট্রের সামষ্টিক নৈতিকতা লোপ পায়। কোন পাড়া বা মহল্লায় গণপিটুনিতে মানুষ যখন উল্লাস করে অথবা গ্রাম্য সালিশের প্রকাশ্য বিচারে নারী বা শিশুর ওপর বিচারের নামে নির্যাতন চালানো হয় আর উৎসুক জনতা নিশ্চুপ থেকে মৌন সম্মতি জানিয়ে তা উপভোগ করে তখন সমাজের মৃত্যুযাত্রা নিশ্চিত হয়। সমাজ দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় সম্পন্ন হয় “ডেথ অফ দ্য সোশ্যাল”।
সামাজিক উন্নয়ন সূচক এর এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক গুলোকে আমলে না নিয়ে শুধু দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা টাইগার ইকোনোমির পিছনে ছুটতে থাকলে উন্নত জাতি হওয়ার দৌড়ে আমরা পিছিয়ে পড়বো যোজন দূরত্বের ব্যবধানে। সমাজ সভ্যতার এই মরণ দশা থেকে উত্তরণের পথে না আগালে আমরা কিভাবেই বা সভ্য মানুষ হবো?
লেখকঃ মোহাম্মাদ বুস্তানী।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মেইলঃbustani.ru.law42@gmail.com