বিল্লাল বিন কাশেম
করোনাভাইরাস বদলে দিতে শুরু করেছে মানুষের নিয়মিত ও দৈনন্দিন অভ্যাস। করোনায় বদলে দিয়েছে প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়মিত অনাচারের অভ্যাস। বদলাতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির গতি প্রকৃতি। করোনার সংক্রমণ ও এর বিশ্বায়নের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, চীনের উহানে করোনা সংক্রমণ শুরু হলেও আজ থেকে সেখান থেকে লকডাউন তুলে দেয়া হচ্ছে। পুরো চীনেই এখন অর্থনীতির চাকা সচল। তাদের অর্থনীতিবিদরা এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে আগামী মাস থেকে তাদের অর্থনীতির গতিপথ নতুন দিকে যাবে।
চীনে করোনার সংক্রমণের শুরু হয় গত বছরের শেষ নাগাদ। দেশটির একজন চিকিৎসক বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। চিকিৎসককে আটক করার সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পর্কিত তথ্য গোপনের পথ নেয় চীন প্রশাসন। সেই চিকিৎসকের মৃত্যু এবং করোনার বৈশ্বিক মহামারির রূপ নেওয়ার ঘটনা এবং পরবর্তী অবস্থা এখন পুরো বিশ্ব জানে। এখন চীনই আবার চলতি মাসে করোনা নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়েছে দৃড়তার সাথে। পাশাপাশি চীন বিশ্বের দেশে দেশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আপদকালীন সময়ে এর আগে উন্নত দেশগুলো মার্কিন নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে থাকতো। এবার সেটিও দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপের দেশগুলো এখন করোনা মোকাবেলা করতে সহায়তা নিচ্ছে চীনের কাছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে চীন কোন মডেল অনুসরণ করেছে বা কেন তাদের মডেল বেশি কার্যকর হয়েছে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। করোনা শনাক্তের কিট থেকে শুরু করে এর সংক্রমণ রোধে কার্যকর উপায়, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহসহ এই দুর্যোগকালীন সবাই চীনের দিকে তাকিয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দেওয়া দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব বহন করছে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক করোনার এই সংকটকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথভাবে সাড়া দিতে পারেনি বলেই আন্তর্জাতিক মহল মনে করছে। করোনার কারণে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে ‘সুয়েজ মোমেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে, ১৯৫৬ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনাটি বেশ স্পষ্টভাবে ধারা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এটিও তেমনই এক মুহূর্ত। শুধু এ দৃশ্যের কুশীলবদের নামগুলো পাল্টে গেছে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই বৈশ্বিক মহামারিতে মার্কিনীদের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। একইভাবে নতুন দিকনির্দেশক হিসেবে সামনে চলে আসছে চীনে। যুক্তরাষ্ট্রে দুর্যোগময় পরিস্থিতির এ সময়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া বক্তব্য সংশয় ও অনিশ্চয়তাই তৈরি করেছে। যেকোনো বড় বিপর্যয়ে সারা বিশ্ব যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে করোনা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমন প্রস্তুতিই নেই। ‘পর্যাপ্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে না’ বলে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা। ইউরোপের সঙ্গে সব দরজা বিনা আলোচনায় বন্ধ করে দেওয়া ট্রাম্প প্রশাসন প্রমাণ করে দিয়েছে যে দুর্যোগে ‘একলা চলো’ নীতি তাদেরকে একা করে দিচ্ছ। প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র আদতে তার জনগণের জন্য সংকট মোকাবিলায় কতটা অপ্রস্তুত।
বৈশ্বিক নেতৃত্বের বদলের ধরনটি হচ্ছে, শুরুতে অতি ধীরগতিতে এর বদল শুরু হয়। পরে হঠাৎ করেই দেখা যায় সব ওলট–পালট হয়ে যায়। এত দিন বিশ্বের নেতৃত্ব যে গোষ্ঠীর হাতে ছিল, এখন আর তা নেই। নতুন কোনো নেতার কাছ থেকে আসছে আদেশ, নিষেধ বা দিকনির্দেশনা। এ ধরনের ঘটনা সর্বশেষ দেখা গেছে ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে। বৈশ্বিক নেতৃত্ব ব্রিটিশ সূর্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত যাওয়ার শুরু তারও আগে থেকে। তবে এর গতি ছিল ধীর। ব্রিটিশদের কাছ থেকে চলে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল তারা দয়া করে বিভিন্ন উপনিবেশ যেন ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আদতে এতোটা সরল ছিল না। যা স্পষ্ট হয় ১৯৫৬ সালে সুয়েজে ব্রিটিশদের গা-জোয়ারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের পতন ঘনিয়ে আনার মধ্য দিয়ে।
কামাল আবদুল নাসেরের মিসরে ব্রিটেনের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফ্রান্স ও ইসরায়েল। কিন্তু জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে মিসর ছাড়তে বাধ্য হয় যুক্তরাজ্য। এটি সারা বিশ্বে নতুন শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে অনেকটা নীরবেই চলে যেতে বাধ্য হয় যুক্তরাজ্য। বৈদেশিক কূটনৈতিক ভাষায়, সাত দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু অর্থ ও ক্ষমতা দিয়েই বৈশ্বিক নেতায় পরিণত হয়নি। যেকোনো সংকটে বিশ্বের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা, গণতান্ত্রিক সুশাসন ব্যবস্থা, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে সংকট মোকাবিলার মানসিকা দেশটিকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই নেতৃত্বগুণ হারিয়ে ফেলার বিষয়টিকে সবার সামনে দৃশ্যমান করে দিয়েছে বেও মনে করেন অনেকে। নেতৃত্বের প্রতিটি মানদণ্ডেই ওয়াশিংটন নিজেকে ব্যর্থ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
ওয়াশিংটন যখন ব্যর্থতায় পর্যদুস্ত, ঠিক তখনই জোর কদমে এগিয়ে এসেছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা বুঝতেই দিচ্ছে না চীন। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা থেকে ওয়াশিংটনকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আখ্যা দিয়ে নানা পরামর্শ ও সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে স্বপ্রণোদিত হয়েই পথ দেখাচ্ছে চীন। বৈশ্বিক মহামারি রুখতে নিজেদের মানচিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সবার হয়ে কথা বলছে ও কাজ করছে দেশটি। চীন যদি শেষ পর্যন্ত এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারে, তবে তা বৈশ্বিক কাঠামোটিই উল্টে দিতে পারে। নেতৃত্বের আসনে নতুন আরোহী হতে পারে চীনই।
করোনার মহামারি চীনসহ বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী দেশের শাসকদের আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি বিদেশি সাংবাদিক তাড়ানোর মতো প্রচুর ঘটনা ঘটছে। চীনেই যেমন বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের পর এবারই প্রথম সবচেয়ে বেশি বিদেশি সাংবাদিককে দেশটি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। কারণ চীনা মডেলের সাফল্যের অন্যতম কারণ ‘কর্তৃত্ববাদ’।
ব্যবসা-বাণিজ্যে চীনা মডেলকে ‘কর্তৃত্ববাদ’-এর কথা তুলে একটু সমালোচনাও করা হতো। কিন্তু এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে চীনের সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবেও বলা হচ্ছে। এই ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটি এখন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে এক বড় তামাশা। মানুষ এই মুহূর্তে বাঁচতে চায়। এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন নিজেকে সামনে নিয়ে আসছে। তবে এই লড়াইয়ের শেষ খেলাটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই। এই মহামারি রোধে ওষুধ ও টিকার খোঁজ দিতে পারলেই অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়েছেও। জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশও এগিয়ে আছে। তবে সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রের পকেটেই ঢোকার সম্ভাবনা বেশি। কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি এবং করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে যে নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে, বৈশ্বিক নেতৃত্বও তার দিকেই ঝুঁকবে নিঃসন্দেহে।
তবে চূড়ান্ত সমীকরণ যা-ই হোক, চীনকে অস্বীকার করাটা আর বোধহয় সম্ভব হবে না। বরং তার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই পরবর্তী বিশ্ব কাঠামোটি নির্মিত হবে বলা যায়। তবে এ কথা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর নেতারা করোনার এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বকে মোটেই নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তাদের তরফ থেকে এমন কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যা বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে। এটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের তাগিদ দিচ্ছে ভবিষ্যৎকে। অতীত মহামারির ইতিহাসেও এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে নেতৃত্বের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে নেতৃত্ব হারিয়েছে। অতীতেরই শিক্ষাও তাই।
যুক্তরাষ্ট্র সময়মতো নিজের অনেক নাগরিকের ‘ভাইরাস টেস্ট’ করাতে পারেনি। পাশাপাশি নিজেও বৈশ্বিক ‘গভর্ন্যান্স-টেস্টে’ এত দিনের অবস্থান হারিয়েছে। দেশটির ডাকে ইউরোপ যুগের পর যুগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে শরিক হয়েছে। অথচ করোনা হানা দেওয়ামাত্র ওয়াশিংটন কোনো ধরনের মতবিনিময় ছাড়াই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাকি বিশ্বের জন্যও কোনো দায় বোধ করতে দেখা যায়নি দেশটিকে। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ‘স্প্যানিশ-ফ্লু’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সময়ে অস্ট্রিয়া আর জার্মানি শক্তিমত্তা হারিয়ে নতুন নেতৃত্বের আসনে বসে ব্রিটেন ও ফ্রান্স।
করোনা বিশ্বায়ন ধারণাকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। করোনা দেখাতে সক্ষম হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বায়নের ধারণা টেকসই নয়। বিশ্বায়নের কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থ। এটি রাজনৈতিক যৌথতা নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। করোনা বিশ্বায়নের অন্ধকার অংশে আলো ফেলেছে। করোনায় আক্রান্ত দেশগুলো যেভাবে নিজ নিজ সীমান্ত নিয়ে সচেতন হয়েছে তাতে স্পষ্ট। বিশ্বায়নের প্রচারণা আর এগোবে না। খোদ ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ও এককভাবে এবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। উল্টো ইউনিয়নভুক্তরা একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করেছে। পুরো বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতার একটা নতুন তরঙ্গ তুলেছে করোনা। বৃষ্টির পরই রংধনু ওঠে এবং রংধনুতে এক-দুটি নয়, থাকে অনেক রং। কিন্তু এই মৃত্যু–বৃষ্টি কবে থামবে, আমরা এখনো তা জানি না। আবার কবে মানুষ উদ্বেগহীনভাবে আনন্দে অপরকে জড়িয়ে ধরবে। কবে মাস্ক খুলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে সেটিই দেখার বিষয়। তবে নিশ্চিত যে মানুষ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে নতুনভাবে।
প্রতিটি বড় বিপ র্যয়ের পর পৃথিবীর মানুষ আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীকে করেছে আরও সুন্দর ও বাস উপযোগী। এবারেও তাই হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। করোনাপরবর্তী বিশ্ব গড়ে উঠবে মানবিক ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবাপন্ন বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী এটিই প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক কূটনীতিক প্রতিবেদক ও আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষক।
মতামত লেখকের সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত।