বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। খাদ্য না খেয়ে বেঁচে থাকে এমন কোন প্রাণী হয়তো পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জীবনধারণ ও দেহের পুষ্টিসাধণের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরাপদ বা বিশুদ্ধ খাদ্য। কিন্তু জনবহুল এই বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত এখন চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কারণ বাজার গুলোতে ফরমালিন ও রাসায়নিক দ্রব ব্যবহৃত খাদ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। কৃষি প্রধান
এই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে ফসল উৎপাদনে পোকা দমনে যত্রতত্র কীটনাশকের ব্যবহার ফিদিন বেড়েই চলছে। কোনপ্রকার নিয়মের বালাই না করে প্রতিনিয়ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে খাদ্য উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুকির আশঙ্কা। ফলে মানুষের নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ এখন সংকটাপন্ন।
দেশের জনসংখ্যা ও খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধির সাথে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত জাতের ফলমূল, শাক-সবজির পাশাপাশি নতুন নতুন ধানও এসেছে। উচ্চ ফলনশীল এসব ধান দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছে ঠিকি কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা জনজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছি। ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক তথ্যমতে, গবেষণার জন্য চালের যে ২৩২ টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিলো, তার ১৩১ টিতে মিলেছে বিভিন্ন মাত্রার ক্রোমিয়াম। ১৩০ টিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম ও সিসা। ৮৩ টিতে মিলেছে আর্সেনিকের অস্তিত্ব; যা রীতিমত ভয়ংকর।
শুধু কৃষকের অসচেতনতার জন্য জন্যই যে খাদ্য অনিরাপদ হচ্ছে এমনটি নয় । কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও অধিক মুলাফা লাভের লোভে পরে খাদ্যে ভেজাল মিশাচ্ছে। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্য যেমন ঝুঁকির মধ্যে পরেছে তেমনি জাতির মেধা ধ্বংস হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পরিবেশ দূষনের পাশাপাশি কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে শিশুরা। বিশেষ করে এসব কীটনাশকের অপপ্রয়োগের ফলে উৎপাদিত খাদ্য মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে থাকে এবং মানুষের শরীরে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। সেইসাথে নানা ধরণের জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি লোক দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতিবছর ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ মারা যায়। এছাড়া পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, প্রতিবছর প্রায় হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। এই সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।
তবে ভয়ংকর ব্যাপার খাদ্যের ভেজালের কারণে শুধু আমাদের দেশেই নয় অনেক উন্নত দেশও অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল এবং হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই স্যালমোনেলা জীবণু বহনকারী আইসক্রিম খাওয়ার ফলে ২ লাখ ২৪ হাজার মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালে দূষিত শামুক ও গলদা চিংড়ি খেয়ে চীনে প্রায় ৩ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। ২০০৮ সালে চীনে তৈরী কয়েকটি কম্পানির গুঁড়োদুধ পান করে বহু শিশু রোগাক্রান্ত হয়। ওই দুধে মেলামাইনের মাত্রা বেশি ছিলো। আমাদের দেশেও ভেজার খাদ্যের ফলে রোগাক্রান্ত হওয়ার খবর প্রতিনিয়ত শুনতে পাওয়া যায় এবং ইদানীংকালে খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল এবং বাজার গুলোতে ভেজাল খাদ্যে সয়লাব হলেও সরকার কিংবা তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এর ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপ তেমন লক্ষণীয় নয়। অথচ দেশে আইনের তো অভাব নেই। অভাব শুধু আইন প্রয়োগের।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়াও জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ডের বিধান থাকলেও এখন অব্ধি কতজন কে এই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। এছাড়াও মাঝেমাঝে বিএসটিআইয়ের ভেজাল বিরোধী অভিযান এবং প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে খাদ্যকে বিপদজনক করার এই প্রক্রিয়া লাগামহীনভাবে চলতে থাকলে একসময় তা মহামারি রুপ নিতে পারে। কাজেই এই সমস্যার আশু সমাধানের জন্য চাই জোড়ালো পদক্ষেপ। আইনের কঠোর বাস্তবায়বের পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে; যাতে করে অন্য কেউ খাদ্যে ভেজাল দেয়ার সাহস করতে না পারে।
এছাড়াও আমার দেশের কৃষকশ্রেণীর বহুলাংশই অশিক্ষিত। ফলে তারা না জেনেই নিয়মবহির্ভূত রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে জনজীবন হুমকির মুখে ফেলছে। তাই তাদেরকে এসব বিষয়ে সচেতন করাটা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। আর সে জন্য সরকারের আন্তরিক হওয়াটা প্রয়োজন । কৃষকদের সচেতনতার পাশাপাশি নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে যাতে করে উৎপাদিত ফসল কোনভাবেই স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ না হয়।
ভেজাল এবং দূষিত খাদ্যে বাজার গুলো সয়লাব হলেও সেইসব খাদ্যের কিন্তু ক্রেতার অভাব নেই। অনেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষরাও জেনে বুঝে এসব খাদ্য ক্রয় করছে ; ফলে বিক্রেতাদের কোন বেগ পেতে হচ্ছেনা। আমাদের বুঝতে হবে যে অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তারা উভয়েই সমান। কাজেই এইসব পণ্য ক্রয় করে অসাধু ব্যবসায়ী দের গতিপথ ত্বরান্বিত করা মোটেও সমীচীন নয়। সচেতন মানুষ হিসেবে তাদেরকে পরিত্যাগ করাই যথাযথ বলে মনে করছি।
ভেজার খাবার গ্রহণের ভয়াবহতা ও ভেজাল খাদ্য বিক্রির কঠিন শাস্তির ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতনতা পূর্বক আইনের কঠোর বাস্তবায়ন জরুরী। প্রয়োজনে বাজার গুলোতে মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে; যাতে কেউ খাদ্যে ভেজাল দিতে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য বিক্রি করতে না পারে। পরীক্ষামূলক ভাবে খাদ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারলেই এই সমস্যার অনেকটা লাঘব হবে বলে আশা করি।
ফয়সাল মাহমুদ আল-মারজান
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়