ব্যারিষ্টার নূর মুহাম্মদ আজমী
কুড়িগ্রামের ডিসির পর যশোর মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড এখন ভাইরাল। নিচে সমসাময়িক ৬টি ঘটনা খবরের বিস্তারিত লিংক সহ উল্লেখ করলাম। কাকতালীয়ভাবে এ ৬টি ঘটনাও এডমিন অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের। মোটাদাগে সবগুলো ঘটনার মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ‘সম্মান/সমীহ’ না করা, ‘স্যার/ম্যাডাম’ না বলে ‘দিদি/ভাই’ ডাকা, ইত্যাদি। ঘায়েল করার জন্যে হাতের কাছে যুতসই অস্ত্রও রয়েছে, “মোবাইল কোর্ট”!
শুধু প্রশাসন ক্যাডারের না, এটি একটি জাতির দেউলিয়াপনার চিত্র। শোনা যায়, ব্যাংক কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না ডাকলে একজন খেটে খাওয়া মানুষকে কড়া ধমক খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের ‘স্যার/ম্যাডাম’ না ডাকলে তাঁরা নাকি বেজায় বিরক্ত হন। আমাদের আইনজীবীদেরও দেখি মক্কেল ‘স্যার’ না ডাকলে অস্বস্তিতে ভোগেন। পুলিশের কথা আর কী বলবো! যেখানে একজন কনস্টেবলও ‘স্যার’ ডাক শুনতে চান সেখানে তারা অন্যের সাথে ‘তুই’ দিয়ে শুরু করেন। সব পেশা, সব অফিসেই মোটামুটি একই চিত্র। হ্যাঁ, ব্যতিক্রমও আছে, তারপরও এটি আমাদের দেশের সার্বিক চিত্র।
কাউকে ‘স্যার’ বলে সম্মান জানানো যেতেই পারে। কিন্তু সেই ‘স্যার’ যদি স্পষ্ট শ্রেণি বিভাজন তৈরি করে, যাকে ‘স্যার’ বলা হলো তিনি যদি নিজেকে সুপেরিওর বা উঁচুজাতের মনে করেন এবং আশা করেন তাকে সবসময় ‘স্যার’ বলেই ডাকা হবে, তাইলে সেই ‘স্যার’এর মধ্যে আছে বর্ণবাদের এক জঘন্য বহিঃপ্রকাশ। আপনি নিজের অধস্তন স্টাফ ছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সর্বদা ‘স্যার’ সম্বোধন প্রত্যাশা করেন, নইলে চরম অস্বস্তিতে ভোগেন এবং ভেতরে ভেতরে রেগে যান। আবার, বয়সে বড় আপনার অধস্তন কাউকে ‘তুমি’তেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ‘আপনি’ বলে ডাকতে পারেননা। হ্যাঁ, আপনি একজন বর্ণবাদী ও শ্রেণি বৈষম্যের ধারক।
আসুন, মানুষ হই, ‘স্যার/ম্যাডাম’ না।
সমসাময়িক ৬টি ঘটনাঃ
#এক– ‘দিদি’ ডাকায় লাথি দিয়ে মাছ বিক্রেতার মাছ ড্রেনে ফেলে দিলেন এসি ল্যান্ডঃ
গত বছরের ঘটনা। ১২ মে ২০১৯ সকালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ এসি ল্যান্ড অফিসের গেইটের পাশে মাছ বিক্রি করছিলেন কয়েকজন মাছ বিক্রেতা। সেদিন গাড়ি নিয়ে অফিসে ঢোকার সময় এক বিক্রেতাকে মাছের ঝুড়ি সরাতে বলেন সহকারি কমিশনার, ভূমি (এসি ল্যান্ড) সঞ্চিতা কর্মকার। তখন লায়েক আহমেদ নামে এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ”দিদি সরিয়ে নিচ্ছি”। এতেই ক্ষেপে যান এসি ল্যান্ড সঞ্চিতা কর্মকার। গাড়ি থেকে নেমে বলেন, “আমি কিসের দিদি!” এর পরই লাথি দিয়ে লায়েক আহমেদ ও তার সঙ্গী হাসান মিয়ার মাছের ঝুড়ি পাশের ড্রেনে ফেলে দেন।
খবরঃ
https://www.jugantor.com/country-news/178484/
#দুই– চলন্ত ট্রেনে ধূমপানে বাধা দেয়ায় এসি ল্যান্ড কর্তৃক ডাক্তার লাঞ্ছিত, অতপর ক্ষমা প্রার্থনাঃ
এ ঘটনাও গত বছরের। ২১ জুন ২০১৯ কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে সিলেট যাচ্ছিলেন ডা. রফিউল সিরাজ। এ সময় মৌলবীবাজার সদরের এসি ল্যান্ড সুনজিৎ কুমার চন্দ ট্রেনের ভেতর ধূমপান করলে প্রতিবাদ করেন সিরাজ। পরের স্টেশনে পুলিশ ডেকে ট্রেন থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ডা. সিরাজকে মারধর ও পা ধরতে বাধ্য করেন এসি ল্যান্ড। ডা. সিরাজের ভাষায়, “একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ধূমপান না করার জন্য তাকে অনুরোধ করলে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘তোদের বাড়ি কই, আমারে চিনস? দাঁড়া সামনের স্টেশনে তোদের সব কয়ডারে বানামু’।” পরবর্তীতে অবশ্য ডা. সিরাজের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন এসি ল্যান্ড সুনজিৎ কুমার চন্দ।
খবরঃ
https://www.jagonews24.com/m/country/news/511741
#তিন– এসি ল্যান্ডের সাথে কথা কাটাকাটির খেসারত, মাদক মামলায় জেলে স্টাফঃ
কয়েকদিন আগের ঘটনা। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) রুমানা আফরোজের কথা-কাটাকাটি হয় নিজ অফিস স্টাফ কাউসারের সাথে। এক পর্যায়ে এসি ল্যান্ড খেপে গিয়ে কাউছারকে বলেন, “তুমি আবার কথা বলছ। তোমাকে আমি টাঙাব।” তখন কাউসার বলেন, “এটা অফিশিয়াল ভাষা নয়। আপনি এমনভাবে কথা বলতে পারেন না।” জবাবে এসি ল্যান্ড বলেন, “কালকেই বুঝবে আমি কী করতে পারি।” এর প্রেক্ষিতে ২ দিন পর কাউসারকে কার্যালয়ে ডাকেন ইউএনও। দেখা করতে গেলে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মাদক মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
খবরঃ
www.prothomalo.com/amp/bangladesh/article/1642800/
#চার– আপনার এতো ক্ষমতা!? – এসি ল্যান্ডকে হাইকোর্টঃ
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে এসি ল্যান্ডের কক্ষে বসা নিয়ে বাকবিতণ্ডার জের ধরে প্রবীণ আইনজীবী নিরোদ বিহারী রায়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেন এসি ল্যান্ড বিরোদা রানী রায়। উক্ত ঘটনায় সেই এসি ল্যান্ডকে হাইকোর্টে তলব করা হলে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চান।
খবরঃ
https://www.jagonews24.com/amp/398155
#পাঁচ– এসি ল্যান্ডের পা ধরতে বাধ্য করা হলো ৫ ব্যাচ সিনিয়র কর্মকর্তা সহকারি অধ্যাপককেঃ
ঘটনাটি একটু পুরনো হলেও বেশ চাঞ্চল্যকর। এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে পিরোজপুর ভাণ্ডারিয়া সরকারি কলেজ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা সহকারী অধ্যাপক মোনতাজ উদ্দিন। তখন এক পর্যায়ে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশ করেন ২৯তম বিসিএসের কর্মকর্তা এসি ল্যান্ড আশরাফুল ইসলাম। এ সময় শিক্ষক মোনতাজ উদ্দিন তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে ক্ষেপে যান তিনি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে এসি ল্যান্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনির হোসেন হাওলাদারকে ফোন করেন এবং পুলিশ ডেকে পাঠান। পরে তাঁরা শিক্ষক মোনতাজ উদ্দিনকে অধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে প্রকাশ্যে ওই এসি ল্যান্ডের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।
খবরঃ
https://www.kalerkantho.com/print-editi…/…/2015/05/26/226220
#ছয়– গতকালের ঘটনা। একজন ইউপি মেম্বারকে বিনা কারণে জনসমক্ষে পেটালেন ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জের এসি ল্যান্ড তরিকুল ইসলাম, ইউএনও রেজাউল করিম বললেন, “আরো পেটানো উচিত ছিল”!
খবরঃ https://www.kalerkantho.com/…/country…/2020/03/28/891677
[প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের মাঝে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের লোকজনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি। আর, সংখ্যায় সর্বাধিক হলেও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের লোকজন চাকরিতে অন্য ক্যাডার দ্বারা বেশি পরিমাণে কর্তৃত্বের শিকার।]
আইনের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা (দায়িত্ব) দেয়া আছে, তার মধ্যেই বিচার কার্যক্রম সীমিত রাখা উচিত। একটা সার্ভিসের যদি কেউ আইনের বাইরে কোন কাজ করে তার দায় সে নিজেই বহন করবে। যারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের শাস্তি দেবে সার্ভিস এবং রাষ্ট্র। তবে এটা ঠিক আইনের বাইরে কাজ যে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই করেন ব্যাপারটা এমন নয়। অনেক সার্ভিসের ব্যক্তিরা এমন কাজ করে থাকেন। এ ব্যাপারটা এমন যে, পরিবারের অবাধ্য ছেলেটা অন্যের বাসার ফল চুরি করে, মারপিট করে এবং সে অপরাধ করলে সবাই বলে এটা স্বাভাবিক কিন্তু সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটি যদি সামান্য অপরাধ করে তবেই হয়েছে। প্রত্যেক সার্ভিসেই এরকম কিছু ব্যক্তি আছেন। তারাই সমস্যা তৈরি করেন। এর দায় পুরো সার্ভিস নিবে না।
লেখকঃ ব্যারিষ্টার নূর মুহাম্মদ আজমী, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
লেখকের সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত মতামত