এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইদ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। বিশ্বব্যাপী চলছে করনা মহামারি। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। এই মহামারির মধ্যেই মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে বন্যা। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের অনেকগুলো জেলায় বন্যার আগ্রাসী রুপ লাভ করেছে। দেশের ৩১ টি জেলায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং ২৮ টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই ৩১ জেলায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের বিভিন্ন নদী ইতোমধ্যে গ্রাস করেছে শতশত বসতবাড়ি, ফসলি জমি, দোকানপাট, মসজিদ,বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্কুল- কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা। জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোিনা, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ জেলাসমূহে বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেজনক। এইসকল জেলার অন্তর্ভুক্ত বেশিরভাগ উপজেলা ও গ্রাম প্লাবিত।ইতোমধ্যে ৮১২১ হেক্টর ফসলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চো উচ্চতায় বইছে তিস্তার পানি। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্নের বসতবাড়ি, আসবাবপত্র, গৃহপালিত পশু ও অন্যান্য জিনিসপত্র। দুইদিন আগে চাঁদপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত একটি বহুতল বিদ্যালয় ও আশ্রয়কেন্দ্র বিলীন হওয়ার দৃশ্য দেশবাসির মনে দাগ কাটে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সি ই জি আই এস -২০২০ এর তথ্যমতে দেশের ১২ টি জেলার ১৬ টি পয়েন্ট অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এইসব এলাকায় ভারি স্থাপনা নির্মাণ না করার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।বন্যা পূর্ভাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে বর্তমানে দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে রয়েছে এবং আশ্রয়হীন মানুষগুলো দিশেহারা। এমতাবস্থায় তারা পরিবারের সদস্য ও গৃহপালিত প্রাণিসহ অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বা মহাসড়কে ঠাঁই নিয়েছে। এরমধ্যে কয়েকদিনের টানা বর্ষণে নদ-নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে এই ঘরহীন মানুষগুলোর জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সাপের কামড়ে আহত ও নিহত হচ্ছে অনেকেই।
আবার মার্চে শুরু হওয়া করোনার প্রকোপ এখনো কমেনি। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ত্রিশের অধিক। কখনো কখনো পঞ্চাশ। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। করোনা পরীক্ষার জন্য মানুষ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছে কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরেও তারা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা। অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও চিকিৎসা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় মানুষ হাসপাতাল বিমুখ হচ্ছে এবং নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছে। দেশে যখন এই অবস্থা বিরাজমান ঠিক তখই ইদ-উল-আজহা সামনে কড়া নাড়ছে। এই বানভাসি মানুষ এবং করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পরিবার ও আক্রান্তদের কাছে ইদের আনন্দ পৌঁছাবেনা। মানুষিকভাবে তারা অবস্থায় সেই অবস্থায় নেই। জীবন বাঁচানোই যেখানে কঠিন হয়ে পড়েছে সেখানে ইদের আনন্দ ভোগ করার সুযোগ আছে সেটা ভাবার অবকাশ নেই। অর্থাৎ বানভাসি মানুষের ইদ আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছে।
২৫ মে ছিল ইদ-উল- ফিতরের দিন। তখন করোনা মহামারী এত ব্যাপকতা লাভ করেনি। করোনা আতঙ্কে মানুষ উদ্বিগ্ন। সেই সংকটময় মুহূর্তে ইদের চারাদিন আগে অর্থাৎ ২০ মে রাতে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। উপকূলীয় জেলাসমূহে ব্যাপক তান্ডব চালায় এই সাইক্লোন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ভোলাসহ উপকূলীয় অন্যান্য জেলাও লণ্ডভণ্ড করে দেয় আম্ফান। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ১০-১৫ ফুট উচ্চতায় প্লাবিত হয় শত শত গ্রাম, ফসলের মাঠ, মাছের পুকুর, চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘের। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় গাছপালা, বৈদ্যুতিক সংযোগ, আম, লিচু ও কলা বাগান, গৃহপালিত পশু-পাখি । বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি ও আক্রান্ত জেলাগুলোতে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ২০ জনের। জরুরি ভিত্তিতে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয় কয়েক লাখ মানুষ।
একদিকে করোনা এবং পবিত্র রমজান মাস চলমান অন্যদিকে আম্ফানের তান্তব। ইদের চারাদিন আগের এই ঘটনায় উদ্বাস্তু মানুষের জন্য খাদ্য,বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২৪ মে ইদের আগের দিন। কয়েক লাখ মানুষ তখনও আশ্রয় কেন্দ্রে। তাদের কাছে তখনো খাদ্য বা ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি।কোথাও কোথাও লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বেড়ি বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাতক্ষীরার কয়রায় ইদের দিন সকালবেলা বাঁধ মেরামতরত অবস্থায় নামায আদায় করে এলাকাবাসি। বেশিরভাগ এলাকায় ইদের নামায আদায় করা সম্ভব হয়নি। চালচুলাহীন অসহায় মানুষগুলো আশ্রয় কেন্দ্রে বা খোলা আকাশের নিচে চাকত পাখির মতো চেয়ে রইলো অথচ কোন সাহায্যের দেখা মিললো না। ইদের দিনেও বেশিরভাগ মানুষের মুখে একটু সেমাই জুটলো না। করোনা মহামারিতে বরাদ্দকৃত ত্রাণের নয়-ছয় অবস্থা সারাদেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমগুলোতেও আলোচনার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণের চাল, ডাল,তেলসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়। ত্রাণের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। সেই সংকট শেষ না হতেই মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। সেখানেও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, ত্রাণ সংকটের বিষয়টি উঠে আসে। এভাবেই ম্লান হয়ে যায় দুর্গত এলাকার মানুষের ইদ আনন্দ!এবার আসলো ইদ-উল-আজহা কিন্তু মানুষের দুঃখের দিন শেষ হলো না। ইদ-উল-ফিতরে করোনা মহামারির সাথে যুক্ত হয়েছিল সুপার সাইক্লোন আম্ফান আর এবার যুক্ত হলো দেশব্যাপী ভয়াবহ বন্যা। দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ার আভাস দিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র। প্লাবিত এলাকায় তেমন ত্রাণ তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি। করোনা ও আম্ফানের মধ্যে একটি ইদ গেল এবং করোনা ও বন্যায় আরো একটি ইদ সামনে আসছে। করোনায় যারা আক্রান্ত লোকজন, মৃত্যুবরণ করা লোকের পরিবার, আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাহাকার ও বানভাসি মানুষ যারা খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বা সড়কে দিনযাপন করছে তাদের জন্য ইদ আনন্দের বার্তা নিয়ে আসেনি। বেদনার যে কালমেঘ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা সরতে সময় লাগবে। এই অন্ধকার কেটে গিয়ে তাদের জীবনাকাশে আলোর ঝলকানির দেখা মিলবে একদিন। তখন আমরা বলতে পারবো তাদের জীবনেও ইদ আনন্দের বার্তা নিয়ে আসবে।
আর এই অন্ধকার দূর করার জন্য সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যারা দায়িত্বপালন করছেন তাদেরকে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। দুর্গতদের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণের যথাযথ বণ্টন নিশ্চিত করা জরুরি। করোনার শুরুতে গরিবের ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যা হয়েছে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এবার বন্যা কবলিত মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ বণ্টনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। আশ্রয় কেন্দ্রে সামাজিক দুরুত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বন্যা কবলিত এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ইদের আগেই শুকনো খাবার, সেমাই, চিনি, দুধ,শিশু-খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে। সামনে ইদ-উল-আজহা তাই দুর্গত এলাকার বিত্তবান ও জনপ্রতিনিধিরা একটু স্বদিচ্ছা পোষণ করলেই এই মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব। তারা যদি ইদের দিন বা ইদের পরদিন কোরবানির মাংস রান্না আশ্রয়কেন্দ্রে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন সেটা অন্যরকম আনন্দ বয়ে আনবে তাদের জন্য। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ঘরবাড়ি বিহীন, আশ্রয়হীন এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ালে ইদের যে অর্থ সেটা আমরা খুঁজে পাবো।
ইদ যে বেদনার হয় সেটা আমরা দেখেছি ইদ-উল-ফিতরে। ঐ ইদকে আমরা আনন্দদায়ক করে তুলতে পারিনি। এবারের ইদ একই প্রেক্ষাকটে এসেছে এবং এই ইদকে আনন্দদায়ক করা সম্ভব। সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে আমরা এবারের ইদ উদযাপন করি এবং ইদের আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দিই এক প্রাণ থেকে আরেক প্রাণে। এভাবেই আমরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই।
লেখকঃ মোখলেছুর রহমান
শিক্ষার্থী
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।