বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিমিনাল জাস্টিস ব্যবস্থায় একজন সাধারণ ভিকটিমকে ন্যায়বিচার পেতে লড়াই করতে হয় একই সঙ্গে ৫টি শক্তির সঙ্গে ১.অভিযুক্ত, ২. পুলিশ, ৩.পাবলিক প্রসিকিউটর, ৪.ক্ষমতাশালী/রাজনীতিবিদ, ৫. দীর্ঘসূত্রিতা/নিজের সঙ্গে ( অন্যায় আপস বা সহ্য করা)!
বৃটিশ উপনিবেশের সময় থেকে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে ক্রাইম শুধু আসামি (অভিযুক্ত) এবং ভিক্টিমের মধ্যকার বিষয় নয় বরং রাষ্ট্র ভিক্টিমের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে, রাষ্ট্রের কিছু ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে ভিক্টিমকে আইনি সহয়তা দেয়, খরচ বহন করে ইত্যাদি। শুনে বিষয়টি খুবই ইতিবাচক মনে হলেও ন্যায়বিচার প্রশাসনে এই থিউরটি এই উপমহাদেশে পরিচিত করানোতে ব্রিটিশদের স্বার্থ ছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো ইতিবাচক নেতিবাচক মিলিয়েই।
বৃটিশরা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম বা অপরাধ বিজ্ঞানের পশ্চিমা ধারণা অনেক সময় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এই উপমহাদেশে প্রয়োগ করে। দন্ডবিধি ১৮৬০ চূড়ান্তভাবে প্রণয়নে ৩০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ পাশ হয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি শাসন ১৭৭০ থেকে ১৮৫৭ সাল সরাসরি বৃটিশ শাসনে আসা পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময় পর্যন্ত ধীরে ধীরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিভিন্ন ফৌজদারী কোড গুলির একত্রিত রুপ দেয়া হয় চূড়ান্তভাবে দন্ডবিধি ও ফৌজদারী কার্যবিধিতে। ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ যা কিছু মাইনর সংশোধনীসহ আজপর্যন্ত এই নামেই বহাল আছে। যদিও ভারতে ১৯৭৩ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি পরিবর্তন করা হয় ফৌজদারী কার্যবিধি ১৯৭৩ নামে পরিচিত। CrPC তে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে একটি ফৌজদারী মামলার মামলা দায়ের থেকে শুরু করে আলামত সংগ্রহ, চার্জশিট বা আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে জামিন দেয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।
ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার অন্যতম অংশ পুলিশ রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত এসবকিছু সরাসরি কোর্টের নিয়ন্ত্রণে নেই। যদিও ম্যজিস্ট্রেট/জজের এসবে হস্তক্ষেপ বা করার কিছু থাকলেও খুব কমই তাঁরা এমনটা করেন বা করতে পারেন। ভিন্ন কিছু প্রমানিত না হলে এর উপর ভিত্তি করেই আদালতকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। কিন্তু দেখা যায় এইক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে তা বিরাট বড়ো অন্তরায়। তবে বিচার ভিভাগীয় তদন্তের বিধানও আইনে আছে। অথচ এটির প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না।
বিচার ব্যবস্থা দুই রকম। যথা-১) Aqusitorial এবং ২) Inquisitorial. এডভাইজেরিয়াল কমন ল বিচার বিচারব্যবস্থায় কোর্টের কাজ তদন্ত করা নয় বরং মামলাকারী ও অভিযুক্ত অভিযোগ বা নির্দোষিতা প্রমাণ করা নিয়ে এক প্রকার প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হয়, যেখানে আদালত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে।
যেখানে কোন অভিযোগ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণীত না হলে আদালত তাকে বেকসুর খালাস দিতে বাধ্য। তবে আদালত চাইলে নিজে থেকেও অনুসন্ধান করতে পারেন। অথচ এর প্রয়োগ বাংলাদেশে তেমন একটা দেখা যায় না। একটি ফৌজদারী মামলায় এজাহার/FIR দায়ের থেকে শুরু করে ট্রায়াল পর্যন্ত আনতে চার্জশিট এবং তদন্ত সম্পন্ন করতে রাষ্ট্রের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং পরবর্তীতে পাবলিক প্রসিকিউটরের (ভিক্টিমের পক্ষে রাষ্ট্রের নিয়োগকৃত সরকারি আইনজীবী) ভূমিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ! (মিডিয়ায় আসা ভাইরাল মামলাগুলো ব্যতীত) এক্ষেত্রে আমরা আবার উল্টোটা দেখি, খুব দ্রুততার সহিত সবকিছু হচ্ছে।
এমনকি রায়ও দেয়া হচ্ছে পাবলিক সেন্টিমেন্টে প্রভাবিত হয়ে। যেমন- নুসরাত হত্যা মামলায়( একটি ভাইরাল মামলা ছিলো) অভিযুক্ত সকলকেই ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়! আর সেই সোনাগাজী থানার ওসির কান্ড আমরা জানি, সম্প্রতি তাকে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটি একটি ভাইরাল বিষয় রাষ্ট্র তো এখানে নড়েচড়ে বসবেই! এই পুলিশ থানা বা ওসি এরকম আরো কতো মামলায় যে বাঁধা হয়ে আছে আমরা তা জানিনা! যাহোক এক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণে বা ন্যায়বিচার নিশ্চিতে রাষ্ট্রের সেই গুরুদায়িত্ব প্রাপ্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সহযোগীতা ছাড়া ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা এক কথায় অসম্ভব। আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক বাস্তবতায় বৃটিশদের এই থিউরী সফলতা এনে দিতে পারেনি সেটা মোটামুটি প্রমাণিত সত্য। বিচার আনয়নে মামলার দীর্ঘসূত্রীতা ছাড়াও কোর্টের বাহিরের এই ফৌজদারী অঙ্গগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। কোর্ট একা একা ন্যায় বিচার এনে দিতে পারেনা, এই সিস্টেমে তা সম্ভব নয়। দেখা যায় ভাইরাল কেসগুলো ব্যতীত আমল অযোগ্য মামলা ( অপেক্ষাকৃত লঘু অপরাধ যেখানে ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনা) বা নালিশি মামলা যা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়ের করতে হয়, এই মামলা গুলোর চিত্র কিছুটা হলেও ইতিবাচক এবং নিষ্পত্তির হার মন্দ নয়।
বিচারক স্বল্পতা ও নানা জটিলতার পরেও এই ক্রেডিট আমাদের বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট কে দিতে হবে। তবে আইনি জটিলতা দীর্ঘসূত্রিতা এসব কারনে হয়রানি ছাড়া চূড়ান্ত অপরাধীর সত্যিকার বিচার নিশ্চিতে ভুক্তভোগীগণ সালিশ বা এডিআরে যেতে চান, ফরমাল সিস্টেমে নয়! GR কেসে (থানায় করা মামলা পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারে) খুব কম মামলায় শেষ পর্যন্ত গড়ায় বা বিচার হয়। উপরন্তু পড়ছে দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে সাক্ষ্যর অভাবে বা সাক্ষীদের ভয় দেখানো হচ্ছে মামলা এগুচ্ছেনা! আর পুলিশের মামলা না নেয়া, আসামিকে সেল্টার দেয়া, অপরদিকে বিনাঅপরাধে গারদে ঢোকানো, মিথ্যা মামলা, অন্যদিকে ভিকটিম পুলিশি সাপোর্ট পায় না এ চিত্র অনেক পরিচিত।ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা বলতে গেলে একরকম মামলা/ হামলা , জামিন, মামলা না আগানো ও খালাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়ে হয়রানি প্রকৃতির বিচার ব্যবস্থায় চলে গিয়েছি আমরা।
ফলে সমস্যা সমাধান বা বিচার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, সিভিল মামলায় এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, Non-judicial Procedure) নিয়ে বর্তমানে অনেক আলোচনা হচ্ছে এবং এটি একটি বিধিবদ্ধ আইনে রুপ লাভ করছে কোর্ট বা কোর্টের বাহিরে সালিসি আপস মীমাংসার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করণে। তা ফলদায়কও বটে। CrPC-তেও এডিআরের বিষয়টা স্বল্প পরিসরে যেমন মিনি-ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি ইত্যাদি রয়েছে। আবার গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬; পৌর বোর্ড আইন, ২০০৪ ইত্যাদিতে এডিআরের বিধান থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ কমই হয়।
ক্রিমিনাল মামলায় এডিআর বিষয়টা আনতে অনেক সতর্কতার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি এবং কোর্টের তত্তাবধানে বা বিচার বিভাগীয় অফিসারগণ নিজে সালিশকারী হয়ে উঠতে পারেন অন্যায় সালিশ বা আইনের অপপ্রয়োগ ঠেকাতে। আদালতের জ্ঞাতবহীর্ভূত এডিআরের ক্ষেত্রে সালিশকারীর যোগ্যতা, আইনি জ্ঞান এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে অবশ্যই। আর ক্রিমিনাল মামলা ফর্মাল বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা ও মামলা জট ও মামলার গুরুত্বের কথা বিচার করে জট এড়াতে বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইবুনালগুলিও আজ মামলা ভারে জর্জরিত। মূলত বিচারক স্বল্পতা আর ফেসিলিটির অভাবে আর উপরে বর্ণিত কারণগুলি দায়ী।
কারণ ওইসব ট্রাইবুনালে আলাদা কোনো বিচারক নেই চলছে জেলা ও দায়রা জজদের মাধ্যমেই। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রইবুনালে মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩%!! যার ফলে ক্রসফায়ার হয়তো ভালো সমাধান মনে করছে সাধারন জনগন! এর এই ভাবনা এমনি এমনি আসেনি যদিও আইনে এটার কোন বৈধতা নেই। শত শত আইন তৈরী করলে বা শুধু শাস্তি বাড়ালেই অপরাধ কমে না! আগে শাস্তি নিশ্চিত করুন! কিন্তু বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে! বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয় নতুন থিউরী আনলেই সব সমাধান হবে মোটেই তা নয়।
অনেকই মনে করেন সিভিল ল লিগ্যাল সিস্টেমের (বৃটেন ব্যতীত পুরো ইউরোপে প্রচলিত) এর inquisitory legal system ( যেখানে কোর্ট সরাসরি বিচার ও তদন্ত দুটোই করে) -এ আমাদের যাওয়া উচিত। কিন্তু আমার মতে আগে গবেষণা জরুরি জরুরি দেশের মানুষের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আইন সম্পর্কে জানার। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন এবং একটি গণদাবি সমাধান তো অনেক আছে প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার! আমাদের দেয়ালে সত্যিই পিঠ ঠেকে গিয়েছে আর এই দূর্দিন ঘুচানোর চাবিকাঠি আমাদের হাতেই!
লেখকঃ তাইমুম আলী আহাদ, শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ (৪১ ব্যাচ) আইন বিভাগ, রাবি।