পৃথিবীতে মেলানিন বেশী নিয়ে জন্মানো যেন এক অবসম্ভাবী অপরাধ , যার শাস্তি কখনো প্রখর কখনো বা নিশ্চুপ। সময়ের কোন ধাপে এসে যে বৈষম্যের মাপকাঠি ধর্ম , বর্ণ, জাতিতে ঠেকে গিয়ে মানব সভ্যতা নিগূঢ় ভাবনায় উৎশৃংখল হয়ে উঠতে শুরু করল তা বোঝা বড়ই দায়। বৈরি এই উত্তেজনা প্রাকৃতিক হোক কিংবা দার্শনিক দুই ক্ষেত্রেই কঠোর অবিচার বলে শোষিতশ্রেনী বরাবর দাবি করে গেছেন । বর্ণবাদ নির্যাতন কিংবা ভেদাভেদের প্ররোচনামাত্র এই ব্যাপারটি চোখে আংগুল দেখিয়ে যে গুটি কয়েক মহান ব্যক্তিত্ব সফলভাবে দেখিয়ে যেতে পেরেছেন তার মধ্যে নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা অন্যতম ।১৮ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল ” মেন্ডেলা ডে ” ১৯১৮ সালের এই দিনে এক কিংবদন্তী জন্ম নেন দক্ষিণ আফ্রিকার সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে । উচ্চ বংশীয় হওয়া সত্বেও বর্ণবাদ তাকে হারিয়েছে পদে পদে।নিম্ন জীবিকার মানুষের হাহাকার তবে কতটা নির্মম হতে পারে তিনি সেটিও অনুভব করতে পেয়েছিলেন। মেন্ডেলা কখনই অধিষ্ঠিত যুক্তিতে পরাভূত হয়েই রঙের গুরুত্ব মানবতা ও অধিকারের উপরে দিতে পারেনি। শোষকগোষ্ঠীর উজ্জ্বলতার আধিপত্যের মধ্যে কি কারণে বদ্ধ থাকবে, তা নিয়ে তিনি পুরো বিশ্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গিয়েছেন। ২৭ বছরের কারাদন্ডতেও তার আন্দোলনের ন্যায়শাস্ত্র পরিবর্তন হয় নি। রবেন দ্বীপ কারাগারের ডি শ্রেনীর অপরাধীর খাবারের পরিমান সাদা চামড়ার মানুষদের চেয়ে কম কেন তা তাকে শোষন ও বৈষম্যের অযৌক্তিকতার সারমর্ম দিত ! তার প্রতি মানুষের অগাধ আবেগ , বন্দি অবস্থায় তার মিথ্যা মৃত্যুর সংবাদে নিস্তব্ধতার মতিভ্রম সৃষ্টি করেছিল যা “ম্যান্ডেলা ইফেক্ট” নামে পরিচিত। পরবর্তীতে বিপুল জনপ্রিয়তার কারনেই তিনি প্রথম গনতান্ত্রিক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তখনকার সময় কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার ছিল না। ব্রিটিশ পক্ষপাতের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, ইংরেজ নাম যুক্ত করার জন্য বাধ্য করা হত। স্কুলের প্রথম দিনই শিক্ষিকা মেন্ডেলার নাম দেন নেলসন। সংগ্রামের দুর্বিসহ এই ছকেই একসময় ব্রিটিশদের কট্টর মানসিকতা হারিয়ে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ জাতির ভোটাধিকার অর্জন করেন, সেই সাদা চামড়ার মানুষদের শাসন করেন! শুধুমাত্র আফ্রিকায় নয় , সমগ্র বিশ্বে তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায় এবং ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরুষ্কার পান ।
প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তিনি একবার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তিনি বাংলার মানুষের সংগ্রামকে আফ্রিকার সমস্যার প্রতিলিপি আখ্যা দিয়েছিলেন। এদেশ ও তার আদর্শে বিমোহিত ছিল । ২০১৩ সালে মেন্ডেলার মৃত্যুতে ৩ দিন শোক পালন করেছিল বাংলাদেশ। ম্যান্ডেলার সেই ধারণাটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক হলেও, সেটি স্বাধীন দেশে কেন্দ্রীয় ভাবে ছড়িয়ে পরার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিল যা ছিল অনস্বীকার্য । বাংলার মাটিও বর্ণ কিংবা জাতি বৈষম্যের ছোবল এড়িয়ে যেতে পারেনি। সংখ্যালঘুদের সাথে বর্বরতার চিত্র খুবই নৃশংস ভাবে ফুটে ওঠে নাচোল বিদ্রোহ, লোগাং গণহত্যা, লংগদু গণহত্যা, তাইন্দং গণহত্যা ইত্যাদিতে। ক্ষমতার চিরচায়িত বর্বর রুপ আমাদের স্বাধীন দেশেও খুব স্পষ্ট! সাদা কালোর এই বৈষম্য ছাপিয়ে অন্য মাত্রার বৈষম্যে বিলীন সমগ্র রাষ্ট্র । লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদ এদেশের এখন ন্যায্য অপরাধ।প্রতিদিন নারীবিদ্বেষী আলোচনা ও অত্যাচারমুখর রমরমা খবরে মাতানো থাকে দেশজ সমাচার। সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন কিংবা অধিকারহরণ এবং ধর্মের নামে লিঙ্গিক বৈষম্যের তীব্রতা ম্যান্ডেলার বর্ণবাদ বিরোধী অনুভূতিকে অপমান করে চলেছে নির্দ্বিধায়। বেশি মেলানিন যুক্ত শরীরের অভিশাপ যেন কাটিয়ে উঠতে পারছে না কুমারী মেয়েরা। শুধু এদেশ নয় প্রকৃত গনতন্ত্র চর্চাকারী দেশগুলোও বর্ণবাদ উপেক্ষা করতে পারছে না! জর্জ ফ্লয়েড , আহমদ আরবারি , স্টিফেন লরেন্সরাই বাঁচতে পারছে না অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের হিউম্যান রাইটস এর কথা তো বাদই দিতে হয়।মেন্ডেলার চিন্তাশক্তি কোন কল্পনার রাজ্যের জন্য ছিল না। এই পৃথিবীর মানুষের জন্য বাস্তব এক পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এত জাতির আদর্শ হলেন তাও ন্যায়ের দৃষ্টিকোণে বৈষম্যতার মায়ায় শোষণের আনন্দ বিসর্জন দিতে পারছে না পৃথিবী । যোগ্যতার মাপকাঠি এখনও খুব সহজেই ধর্ম, বর্ণ, জাতিতে আটকে যায়। তবে হয়তো এমন মহান ব্যক্তিদের আদর্শের আদলেই তা সংশোধিত হতে থাকবে কিংবা জনসমুদ্রে প্রতিদিন জন্ম নেবে মেন্ডেলারা , এই প্রত্যাশাতেই চির অমর ম্যান্ডেলাও বুঝি নিজেকে আরেকবার আজ উপলব্ধি করছে —শুভ জন্মদিন নেলসন মেন্ডেলা।
ফাতিমা ইয়াসমিন ইভা
আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।