ফয়জুল্লাহ ফয়েজ
মামলা জট নিরসনে ই-জুডিশিয়ারির সাথে দরকার ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা:
ই-জুডিশিয়ারির ধারণা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন, মহামারি করোনার কারনে ই-জুডিশিয়ারির অংশবিশেষ এদেশের মানুষ দেখতে পেয়েছেন, তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব, কোর্ট স্টাফদের সদিচ্ছার অভাব, বহু আইনজীবীর সদিচ্ছার অভাব, টেকনোলজি সম্পর্কে আইনজীবী ও কোর্ট স্টাফদের স্বল্প ধারণা, ভার্চুয়াল আদালতেও ওকালতনামা, কোর্ট ফি, বেইল বন্ড ম্যানুয়ালি চলা, অনেক সময় জিআর সেকশন থেকে আদেশ জেলখানায় পাঠাতে দেরি করা বিচারাঙ্গনের লোকজন ও বিচারপ্রার্থীদের খুব একটা স্বস্তির ব্যবস্থা না করলেও, বন্ধ আদালত ভার্চুয়ালি খুলে দিয়ে ই-জুডিশিয়ারির অনেকগুলো ধাপে এগিয়ে যাওয়া কে টেকনোলজি প্রিয় প্রত্যেক সচেতন নাগরিক ই সাধুবাদ জানাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
তবে ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ, সকল নাগরিকের কাছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, উন্নত মানের ইন্টারনেট, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অতি প্রয়োজন। কোর্ট ফি, ওকালতনামা ডিজিটাল করা, আদালতের সকল প্রসিডিংস ডিজিটাল করা, মামলার তথ্য অনলাইনে আপলোড করা, ডিজিটাল ওয়ারেন্ট ও সমন চালু করা, থানা ও আদালতের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা এবং সৎ লোকের দায়িত্বে জুডিশিয়ারি কে রাখা অতি প্রয়োজনীয় বলে আমি মনে করি।
ই-জুডিশিয়ারি তে কিছু মামলা আগাগোড়া ই ভার্চুয়ালি বিচার কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব, কিছু অর্ধেক ভারচুয়ালি অর্ধেক ম্যানুয়ালি এবং কিছু সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি চলা দরকার। বিচারকাজের গতি বৃদ্ধি, প্রতারণা থেকে অনেকাংশে মুক্তি এবং বিচারপ্রার্থীদের কাছে তার মামলা সম্পর্কে তথ্যের সহজলভ্যতা অবশ্যই বিচারকাজের জন্য নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে।
তবে মামলাজট নিরসনে এবং ভূমি সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব নিরসনে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন, বাংলাদেশের দেওয়ানি মামলা সমূহের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ই হয় ভূমি সংক্রান্ত, এক ই জমি একাধিকবার হস্তান্তর, খতিয়ানে নাম ভুল, নামজারি না হওয়া, হয়ে বাতিল হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মোকদ্দমা সংখ্যা প্রচুর।
অথচ যদি একটি ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা থাকতো তবে কত ই না ভালো হতো! সেক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের এনআইডির বিপরীতে একটি করে ল্যান্ড এ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হবে এবং তার এ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টে তার যত জমি আছে তার বর্ণনা থাকবে, সে জমি থেকে কোন জমি বিক্রি করলে ঐ জমি সাথে সাথে ডেবিট হয়ে যাবে, নতুন জমি কিনলে ক্রেডিট হয়ে যাবে, ক্রয় বিক্রয় সব দলিল সমূহ তার এ্যাকাউন্টের বিপরীতে আপলোড থাকবে, কোন ব্যক্তি এ্যাকাউন্ট হোল্ডারের জমি যাচাই-বাছাই করতে চাইলে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনলাইনে ই আবেদন করবেন এবং অনলাইনে ই জমি আছে কিনা যাচাই বাছাই করা যাবে, বর্তমানে টাইটেল দলিল সার্চ করতে প্রচুর খরচ হয় তবুও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, সেই সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
কোন জমি বন্ধক বা বায়না করা থাকলে ঐ জমির বর্ণনার পাশে সেই তথ্য ও থাকবে, আরজেএসসি যেমন চার্জ ক্রিয়েশনের রেকর্ড ডিজিটালি রাখে তেমনিভাবে জমির চার্জ ও রেকর্ডেড থাকবে, এক্ষেত্রে এক জমি দুইবার হস্তান্তরের কোন সুযোগ থাকবে না।
খাজনা পরিশোধ হবে সম্পূর্ণ অনলাইনে এ্যাকাউন্ট অথবা মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে, খাজনার অনলাইন পেমেন্ট স্লিপ দেয়ার সাথে সাথে এ্যাকাউন্টেও খাজনা সম্পর্কে একটা রিপোর্ট থাকবে, আলাদা নামজারির কোন দরকার হবে না, নতুন করে খতিয়ান করার দরকার হবে না। শুধুমাত্র নামজারি সংক্রান্ত জটিলতায় সহকারী কমিশনার (ভূমি), ডেপুটি কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার, ল্যান্ড আপিল বোর্ড, হাইকোর্ট ডিভিশন, আপিলেট ডিভিশন (আপিল ও রিভিউ), এরকম সাতটি ফোরামে মামলা হতে পারে, এই মামলা কত বছরে শেষ হবে তার নিশ্চয়তা নেই, তদুপরি নামজারির জন্য রয়েছে বিশাল অঙ্কের খরচ যেটা অধিকাংশ ই ঘুষ আকারেই যায়। অথচ ডিজিটাল ব্যবস্থায় আলাদা নামজারির দরকার ই হবে না দলিল হওয়ার সাথে সাথে অটো আপলোড হবে এবং ক্রেতার এ্যাকাউন্টে জমি চলে যাবে।
এরকম একটি ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা হলে মামলা অনেক কমে যাবে এবং ই-জুডিশিয়ারির জন্য অনেক সহায়ক হবে, বর্তমানে যেমন ভলিউম তলব দিয়ে দলিলের সঠিকতা যাচাই করা হয়, তখন সেটা অনলাইনে কয়েক মিনিটেই হয়ে যাবে বেঁচে যাবে মূল্যবান সময় ও খরচ, একটি জমি একাধিকবার হস্তান্তর না হলে কমে যাবে মামলা, নামজারির ঝামেলা না থাকলে দৌড়াতে হবে না সাতটি স্হানে, নকশা উঠানোর জন্য যে খরচ করতে হয় তা আর দরকার হবে না যদি থাকে ডিজিটাল ম্যাপ, কয়েকদশক পরপর নতুন জরিপের জন্য হবে না কোটি টাকার খরচ, করতে হবে না ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল।
তবে ডিজিটাল করতে হবে সততার সাথে যদি ও সেটা বাংলাদেশে অসম্ভব প্রায়, ডিজিটাল করা নিয়ে হয়তো ১০/১৫ বছর নতুন কিছু মামলা মোকদ্দমা তৈরি হবে, তবে স্হায়ী ও টেকসই সমাধানের জন্য ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই-
ফয়জুল্লাহ ফয়েজ
এ্যাডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট