মোঃ নাঈমুর রহমান নাঈম
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই প্রায় প্রতিটি মানুষের মাঝে এক ধরণের অপরাধ প্রবনতা কাজ করে। কারোর অপরাধ প্রবনতা প্রকাশিত হয় আবার কারোর টা অপ্রকাশিত থেকে যায়। এই অপরাধ প্রবনতা কাজ করে দুই ভাবে। প্রথমটি হলো, যখন মানুষ অপরাধ করার সুযোগ পায় বা অপরাধ করার মতো অনুকূল পরিবেশ পায় তখন তার মাঝে থাকা এই অপরাধ প্রবনতা প্রকাশ পেতে শুরু করে, এক্ষেত্রে সে ইচ্ছাকৃতভাবেই অপরাধ করে থাকে। দ্বিতীয় টি হলো, অনেকটা বাধ্য হয়ে বা নিজেকে সামলাতে না পেরে নিজের অজান্তেই অপরাধ করা যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে। মানুষের এই অপরাধ প্রবনতার সাথে পরিবেশ – পরিস্থিতির সম্পর্ক অতি নিবিড়। যার কারণে পরিবেশ ভেদে অপরাধের ধরণ বদলে যায় বা একই অপরাধ বিভিন্ন রকমের রূপে সংঘটিত হতে দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধরুন একজন পেশাদার খুনী টাকার বিনিময়ে একজন কে খুন করছে। এখানে খুনীর সাথে ভিকটিমের কোন বিবাদ নেই। আবার একই অপরাধ অন্য একজন করছে ভিকটিমের সাথে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে। এখানে প্রেক্ষাপট ভিন্ন কিন্তু অপরাধ একই।
এবার আসি আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই অপরাধ প্রবনতা কিভাবে কাজ করে?
আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা অনেকটা গ্রামের বাঁশ দিয়ে তৈরি সাঁকোর( ব্রিজ) মতো। বাঁশের সাঁকো দিয়ে জলাশয় পাড় হতে গেলে যেমন নানা বাধা বিপত্তি আসে, চলার গতিবেগ খুবই মন্থর হয় ঠিক তেমনি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় একটি অপরাধের ন্যায় বিচার করতে হলে অপরাধীকে যতোটা সাবলীলভাবে বিচার প্রকৃিয়ার চূড়ান্ত ধাপে নিয়ে যাওয়া উচিৎ স্বপ্ল সময়ের মধ্যে, ঠিক তেমন টা সম্ভব হয় না । একটা বিচার করতে করতেই ১০-২০ বছর গেলে যায়। এই দীর্য সময়ে এক মামলার আসামি আরো ১০-২০ টা অপরাধ করার সুযোগ পেয়ে যায়। কারণ নানা অজুহাত দেখিয়ে জামিন নেওয়াটা আমাদের আদালতে খুবই সহজ একটা ব্যাপার। দীর্ঘ সময়ের কারণে বিচার যেন অবিচারে পরিনিত হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিচার ই হয় না, অনেক মামলা আছে আমাদের দেশে যেগুলো পুলিশ রিপোর্টের অপেক্ষায় বছরের পর বছর ফাইলে আটকা পরে আছে। এর প্রধাণ কারণ আমাদের সনাতন বিচার প্রকৃিয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাব আর তার সাথে ঘুষের প্রচল।
এবার আসা যাক মূল কথায়, আমাদের এই ঘুনে ধরা বিচার ব্যবস্থা আমাদের সমাজের মানুষের অপরাধ প্রবনতা প্রকাশ করার চরম সুযোগ করে দিয়েছে। যখন একটি খুন বা ধর্ষণের বিচার সঠিকভাবে হয় না তখন আরেক জন অপরাধী ভেবেই নেয় যে আরে ঐ অপরাধী খুন / ধর্ষণ করলো, ওর কিছু হলো না, তাহলে আমার ও কিছুই হবে না। ঠিক এই চিন্তাটায় আমাদের সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন তনু, নুসরাত ধর্ষণ মামলার বিচার হয়নি অথবা ধীর গতিতে চলছে, তখনই লক্ষ্মীপুর সদর থানায় ঘটে গেল আরেকটি মর্মান্তিক ধর্ষণের ঘটনা। বিচারহীনতার কারণে জীবন দিতে হলো পরিবারের একমাত্র আশার আলো নবম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্রী হিরামণি কে। আজ যদি তনু, নুসরাত, আবরার,সাগর-রুনী,রিফাত শরীফ সহ সকল হত্যা, ধর্ষণ মামলার সঠিক বিচার করে অপরাধী কে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত তাহলে হিরামণিদের মতো নিষ্পাপ প্রাণগুলো অকালে ঝড়ে যেতে হতো না।
তাই, সমাজ ব্যবস্থাকে ঠিকিয়ে রাখতে হলে, দেশে অপরাধ প্রবনতা কমিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের এখনি এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে । সেই সাথে ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য বিচার ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে আর নিশ্চিত করতে হবে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা।
লেখকঃ মোঃ নাঈমুর রহমান নাঈম, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া মোবাঃ ০১৯৭৩-৬২৫৬৯৬