অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী রয়েছেন যাঁদের সাবমিশনের সময় পুরো আদালত কক্ষ নিরব হয়ে যায়। আদালত রুমের সকলের মনোযোগ থাকে সেই বিজ্ঞ আইনজীবীর বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তি নির্ভর ও জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যের দিকে। আবার অনেক আইনজীবী রয়েছেন যাঁদের সততা ও স্বচ্ছতার উপর মাননীয় আদালত আস্থা রাখেন নির্দিধায়। আদালতের সামনে বিজ্ঞ আইনজীবীদের উপস্থাপন দক্ষতা ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনা শুনলে তাঁদের প্রতি মনের অজান্তেই একটা শ্রদ্ধা চলে আসে। একটি আস্থার জায়গা সৃষ্টি হয় তাঁদের মেধা ও প্রজ্ঞার উপর। শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নন, ভাল আইনজীবীদের মেধার উপর আস্থা রাখেন মাননীয় আদালত এবং সাধারণ আইনজীবীরাও। কোন জটিল বিষয় সমাধানের লক্ষ্যে প্রথিতযশা আইনজীবীদের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য অনেক সময় আদালত তাঁদের এমিকাস কিউরি হিসেবে মতামত প্রদান করার জন্য আহ্বান জানান।
আবার, অনেক শ্রদ্ধেয় আইনজীবী রয়েছেন, যাঁরা নামমাত্র ফি নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকছেন অবিরত, নিরবে নিভৃতে। কোনরূপ ফি ছাড়াই অবহেলিত বিচারপ্রার্থীদের আইনী পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আইনজীবীর নিকটেই আসেন প্রথম। একজন আইনজীবীই প্রথম ত্রাতা হিসেবে বিচারপ্রার্থীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্রতী হন এবং উপযুক্ত কোর্টে বিচারপ্রার্থীকে উপস্থিত করেন। মামলার শেষদিন পর্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ করে, বিচারপ্রার্থীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেন।
একজন ভাল আইনজীবী হওয়া মুখের কথা নয়। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে, আর্থিকভাবে সাদামাটা জীবন যাপন করে, সিনিয়রদের সাথে থেকে ভালভাবে আইন পেশা রপ্ত করতে পারলেই কেবল একজন আইনজীবী হওয়া যায়। আর একজন ভাল আইনজীবী হওয়া আরও কঠিন। বার কাউন্সিল হতে সনদ নিলাম এবং সিনিয়রের পিছনে দু’এক বছর ঘুরেই ভাল আইনজীবী হয়ে গেলাম- বিষয়টি ঠিক সেরকম নয়। ভাল আইনজীবী হতে হলে সনদ এবং সিনিয়রের সাহচর্য ছাড়াও থাকতে হয় নিজস্ব মেধা ও দক্ষতা।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের সনদ পেয়ে আইন পেশা ভালভাবে রপ্ত করতেই ব্যয় হয়ে যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু অনেকেই সে সময় চাকুরীর পরীক্ষা দিয়ে দ্রুত জজ হয়ে কিংবা সরকারি চাকুরী পেয়ে সমাজের ভাল পজিশনে উন্নীত হয়ে যান। সাথে সুশ্রী কিংবা সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে বিয়ে করে পেয়ে যান বিলাস-বহুল জীবনের নাগাল, আরও পান প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, বলা-না-বলা নানান সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু সেসময় একজন আইনজীবীর থাকেনা নিশ্চিত কোন আয়ের ব্যবস্থা। বিয়ে করার জন্য পাননা ভাল কোন পাত্রী। পাত্রীর অতি বাস্তববাদী গুণধর বাবা-মায়েরা তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না আইনজীবীর সাথে, সব সময় খোঁজেন নিশ্চিত আয়ের পাত্র। এক্ষেত্রে সরকারি চাকর পেলে তো কথাই নেই। শুরু হয়ে যায় বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়-জোড় আর পাত্রকে উপঢৌকন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কার্যক্রম। অন্যদিকে, পাত্র আইনজীবী শোনা মাত্রই ভীতু-স্বার্থপর লোকগুলি কোন দিকে যে দৌড়ে পালাবেন- সেটি খুঁজে পান না। এই হলো একজন আইনজীবীর বাস্তবতা।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চতুর্মুখী আর্থিক ও সামাজিক চাপ সামলিয়েই একজন আইনজীবীকে হতে হয় বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে, একজন ভাল আইনজীবী হওয়া একজন জজ হওয়ার চেয়েও কঠিন বিষয় এবং একজন ভাল আইনজীবী দশ-বিশটা জজের চেয়েও সমাজে বেশি অবদান রাখার সক্ষমতা রাখেন। আবার, আইনজীবীদের তরুণ বয়সে সিনিয়র ভাল না হলে হয় আরেক বিপদ। অহরহ অভিযোগ রয়েছে, সিনিয়ররা তাঁদের জুনিয়রদের ভালভাবে হাত খরচ দেন না। কষ্ট করেই চলতে হয় অনেক জুনিয়রকে। এত চড়াই-উতরাই পার করে একজন আইনজীবী হওয়ার পরেও একজন আইনজীবীর নেই কোন যথাযথ পেশাগত সম্মান ও সুরক্ষার ব্যবস্থা।
অনেক বিজ্ঞজন প্রায়শই বলে থাকেন, বিচার ব্যবস্থায় বিচারক এবং আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা। দুজনে একই দেহের অংশ। শুধু কাজের ধরনটি আলাদা। আজ যিনি আইনজীবী, কাল তিনি বিচারপতি। বিচারক ছাড়া যেমন বিচারকার্য চলে না, তেমনি আইনজীবী ছাড়াও বিচারকার্য পরিচালনা করা যায় না। একজন আইনজীবী যেভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেন, সে তুলনায় একজন আইনজীবীর নেই কোন আইনগত মর্যাদা, নেই পেশা পরিচালনা করার জন্য যথাযথ সুযোগ-সুবিধা।
বিচার বিভাগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও আইনজীবীদের জন্য নেই ভাল কোন অফিসের ব্যবস্থা। বার কাউন্সিল প্রতি বছর যে পরিমাণ আইনজীবীদের সনদ দেয়, সে পরিমাণ আইনজীবীদেরকে লোকাল বারে কিংবা সুপ্রীম কোর্ট বারে বসতে দেওয়ায় মত জায়গা আছে কিনা- সেটি কী তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন? আমরা বলছি, বিচারক ও আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা। শুধু বিচারক দিয়ে বিচারকার্য চলে না। প্রকৃত অর্থে, একজন আইনজীবীর হাতেই একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায় বিচার নির্ভর করে অনেকাংশে। কেননা, একজন ভুক্তভোগী সরাসরি বিচারকের কাছে যেতে পারেন না। আইনজীবীর কাছেই তাঁরা প্রথমে আসেন। আইনজীবীই প্রথম তাঁদের বিপদের কথা শুনে-বুঝে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিচারপ্রার্থীকে ন্যায় বিচার প্রপ্তির জন্য বিচারিক কার্যক্রমে প্রবেশ করান এবং মামলার শেষদিন পর্যন্ত পাশে থাকেন। তারপরও আইনজীবীদের পেশাগত প্রতিকূলতাগুলোকে কখনই আমলে নেওয়া হয় না ভালভাবে। বর্তমানে লোকাল এবং সুপ্রীম কোর্ট বারে হল রুমে বসেই অনেক ভাল ভাল আইনজীবীকে পেশা পরিচালনা করতে হচ্ছে।
এছাড়াও, একজন আইনজীবীর জন্য নেই কোন পেশাগত সুরক্ষা ব্যবস্থা। মাঝে মাঝেই আমরা আইনজীবীদের হয়রানির খবর শুনছি পত্র-পত্রিকায়। নির্যাতিত এবং অসহায় বিচারপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক আইনজীবীই সমাজের ক্ষমতাশালীদের দ্বারা নানাভাবে হেনস্থা এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীদের মাধ্যমেও হয়রানি করা হচ্ছে। একজন বিচারপ্রার্থীর সাথে সরাসরি জড়িত থাকার ফলে একজন আইনজীবী বিপক্ষ শক্তি এবং সমাজের নানা দুষ্টুচক্রের চক্ষুশূল হন। ফলে একজন আইনজীবীর পেশাগত সুরক্ষা আইন প্রণয়ন একটি সময়ের দাবী। কোন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে যে কোন প্রকার আইনগত প্রসেস ইস্যু করার আগে অবশ্যই বার কাউন্সিলের পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের একতাবদ্ধ হওয়া এবং বার কাউন্সিলের যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করা খুবই জরুরী।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং ল’কলেজ গুলি প্রতি বছর হাজার হাজার আইনের ছাত্রদের সনদ দিচ্ছে। কিন্তু এই ছাত্রগুলি পাশ করার পর কিভাবে তারা তাদের জীবিকা অর্জন করবে কিংবা কিভাবে পেশায় টিকে থাকবে কিংবা এত পরিমাণ আইনের স্নাতক বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার আছে কিনা- সে বিষয়ে তাঁরা কতটুকু চিন্তা করেন তা সত্যিই অজানা। বর্তমানে বাংলাদেশে মামলার তুলনায় আইনজীবীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সুপ্রীম কোর্টেই দশ হাজারের অধিক আইনজীবী রয়েছেন। লোকাল বারগুলি মিলিয়ে রয়েছেন হাজারে হাজারে। এর মধ্যে অনেক প্র্যাকটিসিং আইনজীবী রয়েছেন যারা নিজদের পেশা পরিচালনা করে ভালভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমসিম খাচ্ছেন। তারপরও প্রতিবছর হাজার হাজার আইনের ছাত্র আইনজীবীর সনদ নিয়ে আইন পেশায় প্রবেশ করছেন।
দেশের সকল বারেই কিছু কিছু আইনজীবী রয়েছেন, যারা পেশা পরিচালনা করে ভাল টাকা আয় করেন। কিন্তু সেটি দেখে পেশার বাইরের লোকগুলি মনে করেন, সকল আইনজীবীই বোধ হয় অনেক টাকা আয় করেন। কিন্তু বাস্তবতা কী ঠিক সেরকম? উৎসাহ নিয়ে অনেক তরুণ আইন পেশায় প্রবেশ করছেন। কিন্তু যাদের পরিবারিক স্বচ্ছলতা কম কিংবা সিনিয়রদের নিকট থেকে সহায়তা পান না তারা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আইন পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। আইন পেশায় টিকতে পারছেন না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নন-প্র্যাকটিসিং আইনজীবীর। একজন আইনের ছাত্র সনদ পাওয়ার পরও কেন আইন পেশায় টিকতে পারেন না- সেটি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি না। নন-প্র্যাক্টিসিং হওয়ার দায় শুধু সেই আইনজীবীর একার নয়, সমাজের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও।
যেহেতু আইনজীবীদের মধ্য থেকেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নির্বাচিত হন, আইনজীবীরাই বিচারপ্রার্থীদের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সার্বক্ষনিকভাবে যুক্ত থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন, সেহেতু আইনজীবীদের গুণগত মান, তাঁদের সংখ্যা এবং তাঁদের জীবিকার সম্ভাব্যতার বিষয়টি উপেক্ষা করা একেবারেই অনুচিত। আইনজীবীদের সনদ দেওয়ার বিষয়টি আরও যুক্তিপূর্ণ, বিবেচনাপ্রসূত ও মানসম্মত হওয়া দরকার। সনদ দেওয়ার মানদন্ড আরও যুগোপযোগী, প্রতিযোগিতামূলক হওয়া দরকার। হাজার হাজার আইনজীবী সৃষ্টি করলাম কিন্তু তাঁদের জীবিকার ব্যাপারটি চিন্তা করলাম না- সেটি কাম্য নয়। আইনজীবীদের সংখ্যা একটি যুক্তিপূর্ণ পরিমাণে রাখা দরকার এবং তাঁদের মেধাস্তরের মধ্যে যেন বিস্তর ফারাক না থাকে সেটি নিশ্চিত করা দরকার। যাতে বিচারপ্রার্থীদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে খুব বেশি তারতম্য না ঘটে এবং আইনজীবীদের সামগ্রিকভাবে একটি আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা যায়- সেটি বার কাউন্সিলের মাধ্যমেই হোক কিংবা স্ব স্ব বারের মাধ্যমেই হোক। আইনজীবীদের কেন্দ্রীয় রেগুলেটরি বডি হিসেবে বার কাউন্সিলকে আইনজীবীদের পেশাগত সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা আইনজীবীরা প্রতিনিয়তই অবহেলার শিকার হতে থাকবেন এবং দেশের বিচারব্যবস্থার গুণগত এবং সংস্কৃতিগত উন্নয়নও বাধাপ্রাপ্ত হবে যুগের পর যুগ।
— রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com