অভিনন্দন ধর
আমার মানহানি হয়েছে। আমি তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। কেউ বুঝে বলে কেউবা না বুঝে। হরহামেশাই এটি শুনে থাকি। মানহানি বুঝতে হলে আগে জানতে হবে মান বলতে কি বুঝাচ্ছে আর কোন কার্যগুলি দ্বারা একজন ব্যক্তির মানহানি হয়।
বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, [১] মান শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্মান, সম্ভ্রম, মর্যাদা।
অর্থাৎ যখন কারো কোন কাজ দ্বারা আপনার এই সম্মান, সম্ভ্রম বা মর্যাদা তে আঘাত লাগে এবং অন্যরা যখন বিষয় টা জানতে পেরে আপনার সম্পর্কে খারাপ মনোভাব পোষণ করে তখন আপনার অতিপ্রিয় মানের হানি হয়, সম্মান হানি হয়। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী,[২] মানহানি অর্থ হচ্ছে সম্মান বা মর্যাদা নাশ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Defamation.
আইনের ভাষায় মানহানি হচ্ছে একজন ব্যক্তির সম্পর্কে মিথ্যা এবং মানহানিকর বিবৃতি প্রকাশ করা যা তার সুনামের উপর আঘাত হানে।[৩]
মানহানি করার পন্থা
এবার আসুন কোন কোন পন্থায় আপনার মানহানি হতে পারে সেটা জেনে রাখি। মানিহানি দুইভাবে হতে পারে, যথাঃ লিখিতভাবে এবং মৌখিকভাবে। লিখিতভাবে মানহানিকে ইংরেজিতে আইনের ভাষায় Libel আর মৌখিকভাবে মানহানি করাকে Slander বলে।
লিখিতভাবে (Libel) মানহানি আবার বিভিন্ন মাধ্যমে হতে পারে, যেমন, লিপলেফট, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সোশাল মিডিয়ায়, চিঠি, বই, কার্টুন, পোষ্টার ইত্যাদির মাধ্যমে।
মানহানির প্রতিকার
মানহানির প্রতিকার হচ্ছে যে ব্যক্তি আপনার মানহানি করেছে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা। টর্ট আইনের ভাষায় এটিকে Felonious Tort বলা হয়। অর্থাৎ মানহানির জন্যে আপনি ফৌজদারি এবং দেওয়ানি উভয় মামলা করতে পারবেন। মানহানি একদিকে দেওয়ানি অন্যায় (Civil wrong) আবার অন্যদিকে অপরাধ (Felony)। এটি উল্লেখ্য যে, ফৌজদারি শাস্তি ভোগ করলেও মানহানিকারী ব্যক্তি দেওয়ানি দায় এড়াতে পারেনা।
দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে
- মানহানি হলে আপনার প্রতিকার হচ্ছে এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানি আদালতে মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করা। যেহেতু মানহানির কোন মানদন্ড নেই সেহেতু সঠিক বা যথার্থ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা সম্ভবপর হয়না, তবে উচ্চতর আদালত কর্তৃক নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরন করে ক্ষতিপূরণের পরিমান নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ (Damages) শুধুমাত্র জরিমানামূলক, দন্ডমূলক নয়। মানহানির জন্য দেওয়ানি মামলায় Equity, Justice and Good conscience অনুযায়ী আদালত মামলার বিচারকার্য করেন।
- আবার যদি মানহানিকর বক্তব্য লিখিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাহলে ১৮৭৭ সালের সুনির্দ্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুযায়ী মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশে বারিত করার জন্যে নিষেধাজ্ঞার মামলাও করা যাবে।[৪]
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে
১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি অপরাধের সংজ্ঞা এবং ৫০০ ধারায় শাস্তির বিধান উল্লেখ আছে। আপনার যদি মানহানি হয় তবে আপনি দন্ডবিধির ধারা ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ অনুযায়ী এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন।
মানহানির শাস্তিঃ
- ধারা ৫০০ অনুযায়ী, যদি কেউ অন্য ব্যক্তির মানহানি করে তবে ঐ ব্যক্তি ২ বছর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সাধারণ কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
- আবার দন্ডবিধির ৫০১ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি জেনে বা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও মানহানিকর বিষয় মুদ্রণ করে বা কোন বস্তুতে খোদাই (ছাপ বা নকশা) করে তবে ঐ ব্যক্তি ২ বছর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সাধারণ কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
- দন্ডবিধির ৫০২ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি মানহানিকর বিষয় সম্বলিত মুদ্রিত বা খোদাই করা বস্তু বিক্রয় বা বিক্রয়ের জন্যে উপস্থাপন করে তবে ঐ ব্যক্তি ২ বছর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সাধারণ কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
মৃত ব্যক্তির মানহানি
It is said that, ‘fame is the food that a dead man eats’. [৩] মৃতব্যক্তি পরলোকে চলে যান, থেকে যায় তাঁর স্মৃতি আর মান মর্যাদা। মৃত্যুর পর ও মৃত ব্যক্তির মানহানি করা হতে পারে।
দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারার ব্যখ্যা ১ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি জীবিত থাকাকালে যদি তাঁর বিরুদ্ধে কোনকিছু আরোপ করা হতো এবং তা যদি তাঁর সুনামে আঘাত করত এবং মানহানি হতো, তাঁর মৃত্যুর পর মৃতব্যক্তির পরিবার এবং অন্যান্য নিকততম আত্মীয়ের অনুভূতিতে আঘাতের অভিপ্রায়ে যদি একই বিষয় করা হয় তবে তা মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে।
দন্ডবিধি অনুযায়ী মানহানির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম
দন্ডবিধির ধারা ৪৯৯ এ ১০ টি ব্যতিক্রম ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। সেসব ব্যতিক্রম পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তির মানহানি হয়েছে বলে বিবেচিত হবেনা এবং তা অপরাধ বলে গণ্য হবেনা।
পাদটীকাঃ
[১] বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, ১ম প্রকাশ ২০১৬, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃঃ ১১০৩।
[২] প্রাগুক্ত পৃঃ ১১০৫।
[৩] Gandhi, B.M. Law of Torts, 2nd Edition (2002), Eastern Book Company, Lucknow, p. 142.
[৪] Ibid, p. 162.
অ্যাডভোকেট অভিনন্দন ধর, আইনজীবী, চট্রগ্রাম ।