মতিউর রহমান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ দুইটি- যুদ্ধ এবং বিচার (War and Justice) । এ দুটির capacity না থাকলে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। কথা হল Administration of Justice প্রতিষ্ঠার আগে কি বিচার হত না? রাষ্ট্র তো প্রতিষ্ঠিত হল কয়েকশত বছর আগে । তার আগে রাষ্ট্র ছিল না। রাষ্ট্র না থাকলে প্রশাসন আসবে কোথা থেকে? জজ নিয়োগ দেবে কে? বিচার হবে কেমনে! প্রাগৈতিহাসিককালে আলোকপাত করলে দেখা যায়, তখন রাষ্ট্র ছিল না।
মানুষ পরিবার এবং বৃহত্তর পরিবার(গোষ্ঠী) মিলে দলবদ্ধভাবে থাকত। তখন বেশি শক্তি যার, সে অনেক কিছুই করতে পারত। মনে করুন, আপনাকে একজন সবার সামনে অকারণে থাপ্পড় দিল, নাকে ঘুষি দিয়ে রক্তাক্ত করে দিল। আপনার মন কী চাইবে? তাকেও একটা থাপ্পড় দিতে অর্থাৎ প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করবে তাই না? Vengeance! মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রতিশোধ পরায়ণ আবার কলহ প্রবণও বটে। ঝগড়া মারামারি মানুষের অতি স্বাভাবিক গুণ। তো আদিকালে বিচার প্রশাসন ছিল না সামান্য কারণে কেউ কাওকে মারত বা খুন করত। Suppose, কেউ আপনাকে একটা থাপ্পড় দিল, অপমান করল।
স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিশোধ (vengeance) নিতে আপনার জিদ চেপে বসবে। প্রশাসন নেই, বিচার করবে কে? নিজের বিচার নিজেই করবেন, যা তা করতে ইচ্ছা হবে আপনার। আপনাকে অপমানকারীর প্রতি প্রতিশোধ নিলেন। এবার সে বা তার পরিবার পরিবার পাল্টা প্রতিশোধ নেবে । আপনাকে পেয়ে হাত কেটে নিল অথবা খুন করল । এবার আপনার পরিবার পাল্টা প্রতিশোধ নেবে । এবার পরিবারে পরিবারে বা গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষ । খুনোখুনি ! এভাবে তখন তারা যাকে মারতে চায়, তাকে না পেলে তার পরিবারের বা গোষ্ঠির কাওকে পেলে তাকে মেরে দিত, রেপ করত ইত্যাদি। ব্যক্তিগত ঝামেলা গোত্রগত ঝামেলায় রূপান্তরিত হত। সামান্য একটা ব্যাপার থেকে যুদ্ধ বেঁধে যেত। চলত বছরের পর বছর । কল্পনা করতে পারেন! প্রতিশোধের আকাঙখায় মানুষ নিজের জীবন দিতেও পিছুপা হত না । সমাজ হয়ে যেত অসভ্য বর্বর। এই ছিল প্রথম স্টেজ ।
এরপর দ্বিতীয় স্টেজ। এ পর্যায়ে মানুষের বোধদয় হল, এভাবে চলতে পারে না। ভিক্টিমের মনকে শান্ত করতে হবে। প্রতিশোধের আকাঙখা একবারেই মিটিয়ে দিতে হবে। এটা আর আগানো যাবে না । কেউ কারোর যতটুকু ক্ষতি করত তাকেও ততটুকু শাস্তি দেয়া হত । আপনাকে কেউ থাপ্পড় দিল, তাহলে তাকে কি শাস্তি দেয়া হবে? ঐ রকম একটা থাপ্পড়? গোত্রের ওরাই মিলে এটার সমাধান করবে ।
হাতের বদলে হাত, চোখের বদলে চোখ, লাশের বদলে লাশ-এই ছিল নীতি ! এভাবে প্রতিশোধ, পাল্টা প্রতিশোধের চেইন থামানো হয়। কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। তখনো বিচার প্রশাসন ছিল না । এভাবে আস্তে আস্তে এক পর্যায়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় । রাষ্ট্র তখন মানুষের সেই vengeance বা প্রতিশোধের আগুন নেভানোর দায়িত্ব নেয় । শুরুর দিকে বিচার প্রশাসন আলাদা কিছু ছিল না। যে রাজা বা নেতা, সেই বিচার করত । আস্তে আস্তে রাষ্ট্র আধুনিক হয় । সেপারেশন অফ পাওয়ারের ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় । সেপারেশন অব পাওয়ারের জনক কে জানেন হয়ত- মন্টেস্কু। এভাবে আইন, বিচার এবং শাসন নামে সরকারের তিনটা আলাদা ভাগ সৃষ্টি হয় । সৃষ্টি হল Administration of Justice।
ক্রমে ক্রমে আদালতের বিভিন্ন স্তর বিন্যাস সৃষ্টি হল। বর্তমান হাইটেকের যুগে ভার্চুয়াল কোর্ট এক অনবদ্য আবিষ্কার। এই বিচার বিভাগের কার্যকারিতার উপরেই আপনার সামাজিক সুরক্ষা নির্ভর করে। অন্যায়ের শিকার হলে বিচার বিভাগ আইনসঙ্গতভাবে আপনার মনের প্রতিশোধের আগুন নেভায়, আপনাকে প্রতিকার দেয়, আপনার জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।
লেখক- মতিউর রহমান, ছাত্র, LL.B 2015-16 সেশন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। email- motiurmdm@gmail.com