মতিউর রহমান
ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত কর্তৃক কাওকে গ্রেপ্তারের আদেশকে Arrest Warrant বলে। Section 54, CrPC অনুযায়ী ৯ টি গ্রাউন্ডে পুলিশ কাওকে ওয়ারেন্ট ছাড়া Arrest করতে পারেন। গ্রাউন্ডসগুলোর মূলভাব হল- কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমলযোগ্য অপরাধের (cognizible offence- গুরুতর অপরাধ ) তথ্য থাকলে, বে-আইনী House breaking implement থাকলে, চুরির মাল থাকলে, পুলিশের অফিসিয়াল কাজে বাঁধা দিলে, সামরিক বাহিনী থেকে পলাতক বলে সন্দেহ হলে, পূর্বে আটকৃত ব্যক্তি পলাতক হলে, সরকার কর্তৃক অপরাধী বলে ঘোষিত হলে ইত্যাদি কারণে পুলিশ আদালতের আদেশ ছাড়াই কাওকে আটক করতে পারেন।
হরহামেশা দেখা যায় পুলিশের কিছু বিপথগামী সদস্য আইনের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ বা প্রমাণ ছাড়াই নিরপরাধ মানুষকে আটক করে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে বা জিম্মি করে চাঁদাবাজি করেন বা বিরুদ্ধ মতের মানুষকে হ্যারাসমেন্ট করেন। BLAST v Bangladesh, 2003, 55 DLR, 363, 373 মামলায় বিনাওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার এবং রিমাণ্ডে নির্যাতনের ব্যাপারে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রুখতে উচ্চ আদালত ১৫ টি নির্দেশনা দেন। এগুলোর সারসংক্ষেপ হল- আটক করে থানায় নেবার ৩ ঘন্টার মাঝে উক্ত ব্যক্তিকে আটকের কারণ সংক্রান্ত বিবরণের একটা কপি দিতে হবে, ১ ঘন্টার মাঝে তার আত্মীয়স্বজনকে inform করতে হবে। উক্ত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকলে তা কেস ডায়েরীতে আঘাতের কারণসহ রেকর্ড করতে হবে (চালানের পর আদালত এটা দেখবেন), ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এছাড়া আদালতে চালানের আগে যদি উক্ত ব্যক্তি তার আত্মীয় কিংবা পছন্দের আইনজীবীর সাথে কথা বলতে চান, পুলিশ তাকে সেই সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে। এরপর গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মাঝে আটককৃত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার পর আদালত পুলিশের কেস ডায়েরী এবং অন্যান্য অবস্থা বিবেচনা করে যদি দেখেন কোন কারণ ছাড়াই উক্ত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে, তাহলে আদালত উক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ধারা 220 অনুযায়ী মামলা আমলে নেবেন, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। অর্থাৎ, জেনে বুঝে বিনা কারণে কাওকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করলে উক্ত পুলিশ সদস্য ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবেন। (এটা ভালভাবে মনে রাখুন।
ধারা ২২০, দদণ্ডবিধি) #রিমান্ডঃ পুলিশ ‘রিমান্ড’ এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। রিমান্ড মানেই নির্যাতন। হাইকোর্টের নির্দেশনা, মানবাধিকার সংগঠন ও সুশীল সমাজের উদ্বেগ সত্ত্বেও রিমান্ডের ভয়াবহতা চলছেই। দেখা গেছে, কোনো মামলায় আসামীকে রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, অথচ ওই মামলায় তিনি বেকসুর হয়েছেন। এমন বহু উদাহরণ আছে, রিমান্ডের আসামিকে মামলায় অভিযুক্ত করা যায়নি। সন্দেহবশত তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন নির্দোষ। জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্যাতনের সুযোগ সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যাতে না পায়, সে জন্যই হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলক ৫৪ ধারায় আটক করে ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নেয়। সেখানে ভয়াবহ নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর সারাদেশে পুলিশি রিমান্ড নিয়ে সোচ্চার হয় বিভিন্ন সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা। রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় বেসরকারি সংস্থা ‘ব্লাস্ট’ হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করে। হাইকোর্ট বিভাগ সরকারকে কারণ দর্শানোর রুল জারি করেন। রুলের জবাবের পর শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট বিভাগ। হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৬৭ ধারা সংশোধন করতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন। একই সঙ্গে ওই ধারাটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত রিমান্ডে নিতে হলে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং রিমান্ড মঞ্জুরের পর কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট একটি গাইডলাইনও দেন আদালত।
এ রায়টি আপিল বিভাগে এখনও বহাল আছে। কিন্তু এসব নির্দেশনার একটিও পালন করা হয়নি। এ রায়ে রিমাণ্ডে জিগাসাবাদের ব্যাপারে আদেশ দেয়া হয়, প্রথমত জেল কাস্টডিতে B2b Room এ (একদিকে কাঁচের গ্লাসের দেয়াল, যেন বাহির থেকে সব দেখা যায় মারধর করা হচ্ছে কিনা) জিগাসাবাদ করা যাবে। কোনভাবেই মারধর করা যাবেনা বা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়া যাবেনা। এরপর পুলিশ কাস্টডিতে রিমাণ্ডে জিগাসাবাদের ব্যাপারে নির্দেশনা হল, পুলিশের Forewarding Letter (চালান) এবং কেস ডায়েরী দেখে আদালত সর্বোচ্চ তিন দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করবেন। এক্ষেত্রে রিমাণ্ডের আদেশ পাসের আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেন। আদালত তার রেকর্ড রাখবেন। রিমাণ্ড শেষে আসামী যদি দাবি করেন পুলিশ তাকে মারধর করেছেন, তাহলে আদালত পুনরায় একই ডাক্তার দ্বারা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেন।
পুলিশ কর্তৃক মারধরের প্রমাণ পেলে উক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন যার শাস্তি ৩ বছর কারাদণ্ড যদি হালকা মারধর হয়, আর যদি গুরুতর আঘাত হয়, তাহলে ৩৩১ ধারা অনুযায়ী ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে সংশ্লীষ্ট পুলিশ সদস্যদের। সংবিধানের অনুচ্ছেদ 35(4) এ বলা হয়েছে,”কাওকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবেনা।” অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) এ বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।” এছাড়া সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৫ এ বলা হয়েছে,”অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের নিকট দোষ স্বীকার করিয়া থাকিলে তাহা তাহার বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাইবে না।” অর্থাৎ পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তি আদালতে আদৌ কোন এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়না। এছাড়া দণ্ডবিধির ধারা 330-331 এ বলা হয়েছে কাওকে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবেনা।
এমন করলে উক্ত পুলিশ সদস্যের ৩ বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে। ধারা ২২০ অনুযায়ী, অকারণে গ্রেপ্তার করলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড হবেআমেরিকায় আটককৃত ব্যক্তিকে জিগাসাবাদের আগে পুলিশের দায়িত্ব হল “মিরিন্ডা ওয়ার্নিং ” দেয়া। অর্থাৎ, পুলিশ নিজে থেকে তাকে বলবেন,”আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নন। আপনি যে তথ্য দেবেন, তা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। আপনি চাইলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন বা চুপ থাকতে পারেন কিংবা আইনজীবীর সাথে কথা বলতে পারেন।” এটা হল আটককৃত ব্যক্তির আইনগত অধিকার। অপরাধী আইনের আওতায় এলে বিচারের রায়ের পর শাস্তি দেবার জন্য অফুরন্ত সময় আছে। কাজেই বিচারের পূর্বে কাওকে একটা ফুলের টোকা দেবার ক্ষমতা পুলিশ বা আইনের কোন লোকের নেই।
জাতি হিসেবে আমরা হয়ত ছোটলোক। তাই এত সুন্দর আইন থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে আইনের লোকেরাই আমরা কেউ কেউ যার যতটুকু ক্ষমতা আছে, তার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে নিজের পকেট ভরি কিংবা উল্লাস করি। ক্ষমতা বা সুযোগ পেলে আমরা নিজেদেরকে আর মানুষ ভাবি না। হয়ত একদিন একটা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, আইনের litera legis বাস্তবে প্রয়োগ হবে নিরন্তর এমন স্বপ্ন দেখে যাই।
আইনের লোকের যৌক্তিক মানসিকতা, আলাপন-আচরণ এবং চরিত্র যত ভাল হবে, দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা তত ভাল হবে। বস্তুত, আইনের লোকের চরিত্রের উপরেই দেশের মানুষের চরিত্র নির্ভর করে যে তারা আইনের প্রতি আস্থা রেখে ভাল হয়ে চলবে নাকি পথভ্রষ্ট থাকবে। একটা বিখ্যাত উক্তি আছে- “Power corrupts man and absolute power Corrupts Absolutely.” ক্ষমতা পেলে মানুষ দুর্নীতি করবেই। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কাজেই কারোর ক্ষমতাকে লাগামহীন রাখা চলবে না।
লেখকঃ- মতিউর রহমান, ছাত্র, LL.B, 2015-16 সেশন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। Email – motiurmdm@gmail.com
মতামতের জন্য লেখকেই দায়ী থাকিবেন।