কোভিড-১৯ আমাদের মনস্তত্ত্বে আটালির মতো লেগে থেকে চোখে আঙুল দিয়ে মোটা দাগে কয়েকটা শব্দ শিখিয়েছে। তন্মধ্যে লক ডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও অনলাইন ক্লাস অন্যতম। অনলাইন ক্লাস নামক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে শিক্ষকেরা একেকজন যোদ্ধা বনে গেছেন। ইন্টারনেটের কচ্ছপসম গতির সাথে আবার যুক্ত হচ্ছে পাল্লা করে শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা দিনে দিনে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। শিক্ষার্থীদের ঊনপঞ্চাশ বায়ু আজ প্রবল হয়েছে।
ইন্টারনেটের গতি অনেক সময় শ্রেণি ও শিক্ষার্থীবান্ধব হলেও শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করার খেলায় মত্ত হচ্ছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে অনেক শিক্ষার্থী আলেয়ার পিছে ছুটছে।
হরহামেশায় ভিডিও গেমস খেলা কিংবা ফেসবুকে চ্যাট করা এখন খুবই মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিড়ম্বনার ষোলো কলা পোহাতে হচ্ছে শিক্ষকদেরকে। ইন্টারনেটের গতি স্বল্পতার ওজর দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিষ্ক্রিয় থাকাটা এখন যেন একটা ভয়ানক ট্রেন্ডে রূপ নিয়েছে। যে যেভাবে পারছে, ফাঁকি দিচ্ছে।
অনলাইন ক্লাসে সবচেয়ে দৃশ্যনীয় বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের নিদারুণ জড়তা, চুপ থাকার নিরলস চেষ্টা। এক্ষেত্রে তাদেরকে অপগণ্ড ভাবাটা বোকামি বৈকি। শিক্ষকদেরকে অসাধ্যসাধন করে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। যে শিক্ষার্থীকে অফলাইন ক্লাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত দেখা যেতো, নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সে এখন অনলাইনের ক্লাসে নিষ্ক্রিয় থাকার মিশনে নেমেছে। শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর না করে শিক্ষার্থীদের অহেতুক চুপ থাকাটা অনেক প্রশ্নের জট সৃষ্টি করছে।
ফেসবুক চ্যাটিং শিক্ষার্থীদের জীবনে বাঁধভাঙা জোয়ার এনেছে। সে জোয়ারে আরেকটু গতি বাড়িয়েছে ফ্রি ফায়ার, পাপজির মতো ভিডিও গেমসগুলো। পড়াশুনার সাথে অন্তরের যে যোগ তাতে বিয়োগ ঘটাচ্ছে এ গেমসগুলো। কারো কারো তো ইতোমধ্যে চোখের বারোটা বেজে গেছে। অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছে অনেকেই। শিক্ষার্থীদের গৃহবন্দী জীবনের সাথে আবার যুক্ত হচ্ছে অভিভাবকদের বেখেয়ালি মনোভাব। সন্তানেরা যেন তাদের সবেধন নীলমণি। অভিভাবকরা ইন্টারনেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সন্তানদেরকে বুঝাতে দারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা খাল থেকে সমুদ্রে পড়া মাছের মতো দিগ্বিদিক ছুটে চলার সময় ও সুযোগ দুই-ই পাচ্ছে। এ সুযোগ তাদের জীবনে আজ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকেরা প্রশ্ন করলেও শিক্ষার্থীরা নিস্তেজ হয়ে বসে থাকছে। তাদের প্রশ্ন করার শক্তি কিংবা আগ্রহ দুই-ই মরে গেছে যেন। জ্ঞানতৃষ্ণা বলতে যে মূল্যবান শব্দ তাদের অভিধানে ছিলো আজ তা তাদের জীবন অভিধান থেকে মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এটা কি তাদের অতিরিক্ত রাতজাগার ফল, নাকি ভিডিও গেমসের ক্ষতিকর প্রভাব, নাকি ফেসবুকীয় আবেশ, নাকি ক্লাসের সময়কে চ্যাট করার সময় জ্ঞান করে তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের মন বিচলিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের দুর্গতির অজুহাত সর্বাগ্রে উপস্থাপন করে নিজেদেরকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভেলায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। যে স্বপ্নকে তারা চিরদিন লালন করে আসছে সেই স্বপ্ন কি কোভিড-১৯ গিলে খেয়ে ফেললো? নাকি তারা অটোপাশের অটোরিকশাতে চড়তে চাইছে? সচেতন মনে অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে আজ। অনেকে আবার মনে মনে পুলকিত হচ্ছে খুব, অটোপাশের স্রোতে তারা দেবে যেন ডুব।
অটোপাশের নব্য সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদেরকে অটোপাশ নামক অক্টোপাসের খাদ্যে পরিণত করলে দুঃখ করার কিছু থাকবেনা। শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্তি তাদেরকে শেষমেষ কোথায় গিয়ে দাঁড় করায় তা দেখার বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী কুড়ের বাদশা বনে গিয়ে সময়কে যাচ্ছেতাইভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এর শেষটা যে অনেক ভয়াবহ হবে তা সুনিশ্চিত করে বলা যায়। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও মনোচিকিৎসকদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হয়েছে কি? সময় বলে দিবে কী ঘটতে চলেছে। ততদিন আমাদেরকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে।
—– মেহেদী আরিফ