সম্ভবত ডিফেন্স সার্ভিস আর বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থীরা জানতে পারেন না ফাইনালি ভাইভা শেষে কতজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হবে। আপাততঃ ডিফেন্স থাক। আইনজীবীদের বিষয় নিয়ে মনোনিবেশ করি। দেশে কতজন প্রাক্টিসিং আইনজীবী রয়েছেন আর কতজন আইনজীবীকে চূড়ান্ত সনদ দেওয়া দরকার- সে বিষয়ে কী বার কাউন্সিলের কোন নীতিমালা রয়েছে?
আইন পেশাটা একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে আনা জরুরী, কতজন আইনজীবীকে সনদ দেওয়া হবে, তাদের জীবীকা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সেগুলো বিবেচনা করেই সনদ দিতে হবে। কেননা, সরকার আইনজীবীদের কোন বেতন দেয় না। এই করোনা মহামারীর সময়েও আইনজীবীরা সরকারের তেমন কোন অনুকম্পা পায়নি।
দেশের জজকোর্ট বারগুলোতে এবং হাইকোর্ট বারে কতজন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী রয়েছেন, তাঁদের হাতে কী পরিমাণ মামলা রয়েছে, তাঁরা ভালভাবে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন কিনা সে বিষয়ে কী বারকাউন্সিল কোন খোঁজ-খবর নিয়েছে? প্রতিবছর আইনজীবীদেরকে সনদ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু অনেক আইনজীবী পেশাগত, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কারণে এই পেশা থেকে ছিটকে পড়ছেন। পেশা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেন শত শত আইনজীবী পেশা থেকে ছিটকে পড়ছেন- সে ব্যাপারে কী বার কাউন্সিলের কোন জরীপ রয়েছে?
এক অর্থে, আইন পেশাকে বলা যেতে পারে একটি মাতস্যন্যায় পেশা যেখানে যোগ্যতাবলে টিকে থাকতে হয়। অর্থাৎ “Survival for the fittest” – নীতি হলো এই পেশার মূল বৈশিষ্ট্য। এখানে কেউ কারও জীবিকা নিশ্চিত করে দেন না, নিজের যোগ্যাতবলেই একজন আইনজীবীকে তাঁর জীবিকা অর্জন করে নিতে হয়৷ মাস শেষে কোন বেতন নেই এখানে। আইন পেশায় যাদের পরিবারের লোকজন আগে থেকে জড়িত রয়েছেন, তাঁরা শেখার ভাল পরিবেশ পেয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেন। তাহলে, যেসব সনদপ্রাপ্ত মেধাবী আইনজীবীরা ভাল সিনিয়র পাচ্ছেন না, হাত খরচ পাচ্ছেন না- তাঁদের কথা কী বারকাউন্সিলে বসে থাকা নীতি-নির্ধারকরা একবারও ভেবেছেন? একজন নবীন আইনজীবী কিভাবে পেশাটি শিখবেন, কিভাবে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করবেন সেব্যাপারে বার কাউন্সিলের বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজন কী কোন ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা ভেবেছেন?
আইনজীবীগণ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন বিচারকের চেয়ে কম অবদান রাখেন না৷ কেননা, একটি মামলার শুরু থেকেই একজন আইনজীবীকে একজন বিচারপ্রার্থীর পাশে থাকতে হয়। মামলার বিষয়টি অনুধাবন করতে হয়, সেটিকে বিচারকের সামনে আইনসম্মতভাবে, লিখিত ভাবে উপস্থাপন করেন দুইপক্ষের আইনজীবীগণ। বিচারক আইনজীবীদের উপস্থাপিত বিষয়ের উপর পর্যালোচনা ও চিন্তাভাবনা করেন এবং তাঁর রায় প্রদান করেন। এক্ষেত্রে আইনজীবীরা একটি মামলা ভালভাবে উপস্থাপন না করলে জজসাহেবের সাধ্য নেই একা একা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা।
বিচারকগণ বেতনভুক্ত এবং নানা সরকারি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধার আওতায় রয়েছেন অথচ আইনজীবীদের সরকার কর্তৃক তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না- উল্টো বছরে বছরে বার কাউন্সিলে চাঁদা দিতে হয়, আইনজীবী সমিতিতে চাঁদা দিতে হয় সমিতি পরিচালনার জন্য।
আইনজীবীদের নিজেদের সমিতির খরচ যদি নিজেদেরকেই বহন করতে হয়, নিজেদের জীবিকার নিশ্চয়তা, জীবিকার ঝুঁকি যদি নিজেদেরকেই নিতে হয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য কোনরূপ পেশাগত ও অবকাঠামোগত সুবিধা না দেওয়া হয় তাহলে প্রতি বছর কতজন আইনজীবীকে সনদ দেওয়া হবে- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বার কাউন্সিল এবং আইনজীবী সমিতির যৌথ আলোচনার মাধ্যমেই হওয়া উচিত। কেননা, বার সমিতিতে কতজন আইনজীবীকে বসতে দেওয়ার মত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, কর্মের কতটা পরিসর রয়েছে কিংবা কতজন আইনজীবীকে ধারণ করার মত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা বার কাউন্সিলের চেয়ে বারের নেতৃবর্গ বেশি জানেন।
সরকার যদি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করতে চায়, তাহলে অবশ্যই সরকারকে আইনজীবীদের বারকাউন্সিল সংশ্লিষ্ট সকল ধরনের ফি মওকুফ করতে হবে।
একজন আইনজীবীকে তাঁর পেশা পরিচালনার জন্য বার সমিতিতে চাঁদা দিয়ে সমিতিকে টিকিয়ে রাখতে হয়। ছোট্ট টেবিল আর দুইটা চেয়ার সংবলিত একটি কিউবিকলসের জন্য আইনজীবীদেরকে সমিতিতে অগ্রীম টাকা দিয়ে তা নিশ্চিত করতে হয়। কেন? সরকার কী ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত আইনজীবীদের একটু বসার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে কিছু টাকা বরাদ্দ দিতে পারে না? নানা ভাবে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করা হচ্ছে। ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত আইনজীবীদের পেশাগত তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা দেয় না সরকার। উল্টো দিকে আইন পেশায় রয়েছে, চরম প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তা। কেননা, এ পেশাটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মেধা ও যোগ্যতা নির্ভর। সনদ পাওয়া মানেই একজন আইনজীবীর জীবন-জীবিকা নিশ্চিত- এ কথা কেউ বলতে পারেন না। অথচ, নিজ পেশা পরিচালনা ও মেম্বারশিপ টিকিয়ে রাখার জন্য একজন আইনজীবীকে বার কাউন্সিল আর বারসমিতিতে চাঁদা দিয়ে যেতে হয় বছরে বছরে।
একজন আইনজীবীর আইনপেশার সূচনা থেকেই নানা অবহেলা আর অস্বচ্ছতার কারণে তাঁর পেশা থেকে ছিটকে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ পেশায় নাই কোন মোয়াক্কেলের
নিশ্চয়তা, নাই কোন মাসিক বেতন, নাই কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কিন্তু ঠিকই আছে বছরে বছরে বার কাউন্সিলের ফি, বার সমিতির চাঁদা। কোর্টে মামলা করতে আসলে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরকার ঠিকই কোর্ট ফি নেয়। জনগণকে যে একেবারে মাগনা ন্যায়বিচার প্রদান করা হয়- সেটি কিন্তু নয়। তাহলে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অবকাঠামোগত খরচ অর্থাৎ বারকাউন্সিলের ফি এবং আইনজীবীসমিতির খরচ কেন আইনজীবীদের বহন করতে হবে৷ যদি সিংহভাগ খরচ আইনজীবীদেরকেই বহন করা লাগে, তবে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আর সকল হর্তাকর্তা আইনজীবীদের মধ্য থেকে নয় কেন? প্রতি বছর কতজন আইনজীবীকে সনদ দেওয়া হবে তা আইনজীবী সমিতির সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নয় কেন?
অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, বর্তমান করোনা মাহামারী আইনজীবীদেরকে তাঁদের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে সহায়তা করেছে। সরকারের উচিত হবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত আইনজীবীদের বারকাউন্সিলের সকল ধরনের ফি মওকুফ করে দেওয়া, দেশের সকল আইনজীবী সমিতির পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করা যাতে আইনজীবীদেরকে তাদের মেম্বারশিপ টিকিয়ে রাখার জন্য, সমিতি পরিচালনার জন্য চাঁদা দিতে না হয়। আর তরূণ আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি আইনজীবী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্টা করা যাতে করে যে সকল তরুণ আইনজীবী ভাল সিনিয়রের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাঁরা যেন এ পেশায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে না পড়েন।
—- রায়হান কাওসার,
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
raihankawsardu@gmail.com
মতামত লেখকের নিজস্ব।