মতিউর রহমান
দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ, সংশোধন ও উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু যদি সেই আইনেই ত্রুটিপূর্ণ জটিলতা থাকে তাহলে জীবন স্বাভাবিক না থেকে অস্বাভাবিক হবে এটিই বাস্তবতা। যেমন বিবাহের ক্ষেত্রে – বিয়েকে কঠিন করে প্রেমকে কার্যত অপরিহার্য ও সহজ করার মাধ্যমে ট্রেডিশনাল মূল্যবোধকে প্রাথমিক বয়স থেকেই ছিন্ন করার উপলক্ষ্য হিসেবে বিভিন্ন দিবস (Rose Day, propose Day, Hug Day, বিবর্তিত valentine Day etc) আমদানি করা হয়েছে। এর পেছনে হয়ত আকাশ সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক মাস্টারমাইন্ড কাজ করছে। অথবা পলিসি মেকারদের মানুষের শান্তির প্রতি মনোযোগের ক্ষেত্রে উদাসীনতা কাজ করছে।
একটা ছেলে বা মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পেয়ে বিয়ে করতে ২৮-৩০ বছর বয়স পার করতে বাধ্য হয়। অথচ তাদের সঙ্গীর চাহিদা শুরু হয় ১২-১৪ বছর বয়স থেকেই। বিয়ে ১৮/২১ বছর বয়স পর্যন্ত আইনত নিষদ্ধ হলেও শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধ এমন জায়গায় আনা হয়েছে যে মেয়েদের লেখাপড়া শেষ করে অর্থাৎ ২৫-২৬ বছর বয়স পূর্ণ করার আগে এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে লেখাপড়া শেষ করা + জব খুঁজে ঠিকমত প্রতিষ্ঠিত হওয়া অর্থাৎ ২৮-৩২ বছর বয়স পূর্ণ করার আগে বিয়ে করা De Facto নিরুৎসাহিত, বা কোন কোন ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। ছাত্র অবস্থায় বয়স ২১+ হলেও কোন ছেলে-মেয়ে বিয়ে করলে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের পদ পাবার অযোগ্য হয়ে যায়। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি এভাবেই সাজানো হয়েছে। কাজেই উন্মুক্ত পথ থেকে গেল প্রেম।
১৮/২১ এর আগে কোন ছেলে-মেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত হয়ে বিয়ে করলেও ২ বছর কারাদণ্ড ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। (ধারা-৭, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭) কিন্তু এই বয়সেই প্রেম, পতিতালয়ে গমন, বা স্বেচ্ছায় শারীরীক সম্পর্কে জড়িত হলে আইনে তার জন্য কোন শাস্তির বিধান নেই। আইন দিয়ে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু বাল্য প্রেম, বাল্য ব্যাভিচারকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অদম্য চাহিদাকে আইন দিয়ে দমন করা সম্ভব নয়।
“আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ১৬ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সম্মতিতে তার সাথে শারীরীক সম্পর্কে জড়ালে সেটাও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। (ধারা-৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০)
মনে করুন, সাড়ে ১৫ বছর বয়সী একটা মেয়ে ১৫ বা ২৫ বছর বয়সী একটা ছেলেকে নিজে থেকে ডেকে নিয়ে স্বেচ্ছায় শারীরীক সম্পর্ক করল৷ আইনে এক্ষেত্রে ছেলেটি মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে (!)”
মনে করুন, সাড়ে ১৩ বছরের একটা মেয়ে ১৪ বছরের একটা ছেলেকে নিজে থেকে ডেকে নিয়ে স্বেচ্ছায় শারীরীক সম্পর্ক করল৷ আইনে এক্ষেত্রে ছেলেটি মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। শাস্তি হবে কেবলমাত্র ছেলেটির। মেয়েটির এখানে আইনত কোন দোষ নেই। তাছাড়া, প্রকাশ্যে অশ্লীলতা করলে (স্বামী-স্ত্রী নাকি অবিবাহিত এটা কোন ব্যাপার না) এবং তাতে যদি অন্যরা বিরক্ত হয়, তবে ৩ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। (ধারা-২৯৪, দণ্ডবিধি, ১৮৬০) আড়ালে বা হোটেলে বা গৃহকোণে এসব করলে আইনে তা অপরাধ নয়।
ব্যাভিচারের ব্যাপারে বিধান হল কেবল মাত্র বিবাহিত মহিলার স্বামী জীবিত থাকলে স্বামীর বিনা অনুমতিতে তার স্ত্রীর সাথে কেউ শারীরীক সম্পর্কে জড়িত হলে শুধুমাত্র সেই স্বামী যদি মামলা করে, তবেই সেটা উক্ত পুরুষের ব্যাভিচারের অপরাধ বলে গণ্য হবে। এবং ব্যাভিচারী পুরুষটির ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। উক্ত মহিলার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা সাঁজা প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ বিবাহিত মহিলার সাথে শারীরীক সম্পর্ক স্থাপন করলে শুধুমাত্র পুরুষটি দোষী হবে, মহিলাটির অপরাধ হবে না। (ধারা-৪৯৭, দণ্ডবিধি, ১৮৬০) অবিবাহিত, বিধবা কিংবা ডিভোর্সি নারীর সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত বা বিপত্নীক পুরুষের শারীরীক মিলনে আইনে কোন বাঁধা নেই। কাজেই স্পষ্ট What the intention of the legislature is… সেই লক্ষ্যেই তারা আইন প্রণয়ন, তার বাস্তবায়ন এবং মিডিয়াকে পরিচালিত করছেন।
সকলকে বুঝতে হবে মানুষের চাহিদা এবং চাহিদা মেটানোর বৈধ উপায়ের মাঝে দূরুত্বের কারণেই বে-আইনী কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রসার লাভ করে। ফলে পতিতালয় প্রতিষ্ঠা, সেখানে গমন, নারী পাচার, নারীদেরকে পতিতালয়ে বিক্রি, প্রেমে প্রতারণা, মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, পর্ণগ্রাফি, প্রেমের ভিত্তিতে শারীরীক সম্পর্কের ভিডিও প্রচার, প্রেমিক-প্রেমিকা বা যাস্ট ফ্রেণ্ড-বেস্ট ফ্রেণ্ডের মাঝে আদানপ্রদানকৃত নগ্ন ছবি-ভিডিও, ফোন-সেক্সের কল রেকর্ডিং, আত্মাকে বঞ্চিত করা, অবিশ্বাসের মহামারী, প্রেম কেন্দ্রিক সংঘর্ষ-মারামারি, ব্যর্থ প্রেমে জীবন নষ্ট, ডিপ্রেশনে ভুগা, অল্প বয়স থেকেই ঘুমের ওষুধের নেশায় ডুবে থাকা, হাত কেটে “অমুক+অমুক” লেখা, নারী বিদ্বেষ বা পুরুষ বিদ্বেষ, ইভটিজিং, ছাত্র বা অপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায় অবস্থায় লিভ টুগেদার বা মাস্টারবেশন, সমকামিতা, ধর্ষণ ইত্যাদি কার্যকলাপের মাধ্যমে যুব সমাজের একটা অস্বাভাবিক জীবন গঠিত হতে বাধ্য হচ্ছে। আর তাতে গোটা সমাজ সাফার করছে।
একটা উপমা দেব, “নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাঁধ নির্মাণ করে বিকল্প প্রবাহের ব্যবস্থা না করলে দু-কূল প্লাবিত হয়ে বন্যা হবেই। তাতে সংশ্লীষ্ট জীবন ও সম্পদের ধ্বঃস অনিবার্য।” সঙ্গত কারণেই যুব সমাজ অস্বাভাবিক অসুখী জীবনে বাধ্য হচ্ছে।
কাজেই, যারা এহেন অপ্রত্যাশিত জীবনে বাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ না করে, সমস্যার মূল কারণ সংস্কারের ভাবনা ভেবে উপযোগী পদক্ষেপ তা নিলে ইফেক্টিভ হবে।
লেখকঃ মতিউর রহমান, ছাত্র, আইন বিভাগ, ২০১৫-১৬ সেশন (LL.B), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।