মোঃ হাফিজুর রহমান
বর্তমানে কোভিড- ১৯ একটি বৈশ্বিক দুর্যোগের নাম।পৃথিবীতে এই দুর্যোগের প্রভাব পড়েনি এমন কোন দেশ নেই। সকল শ্রেণি পেশার মানুষই কোন না কোন ভাবে করোনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই মহামারী ভাইরাস সবাইকেই আক্রান্ত করছে। এটা কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, দেশ, জাতি কাউকেই চিনে আক্রান্ত করছে না। এই অবস্থা কতদিন থাকবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পর্যটন কৃষি মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রণোদনা ও সহায়তার মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এদেশে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে। একসময় মানুষকে অক্ষরজ্ঞান করতে গণ শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়েছে। এখন অবস্থা অনেকটা বদলেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য ৫৩ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০৩ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
ফলে আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার হার বেড়েছে। এই উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায় । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাকার্যক্রম ক্ষতির সম্মুখীন । আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সমাজে আয়ের বৈষম্য রয়েই গেছে। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তুমুল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে তুখোড় মেধাবীরা জায়গা করে নেয় ;যাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিরাবের সন্তান। একটি জাতি গঠনে স্বভাবতই মেধাবী ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই। সেখানে দেখা যায় গরীব ছেলে মেয়েরা খুব কষ্টে তাদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের বেতন, ফরম পূরণসহ আনুষঙ্গিক খরচ, থাকা খাওয়ার খরচ বহন করতে হিমশিম খায়। এসব ব্যয় বহন করতে কেউ কেউ দিনে ৫/৬ টি টিউশনি করে থাকেন। কেউ শিক্ষা ঋণ নেন, কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা বৃত্তি পান, এছাড়াও অনেকেই কোন আত্মীয়ের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাদের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যান।
এখন যেহেতু পরিবর্তিত পরিস্থিতি সেখানে গরিব শিক্ষার্থীরা তাদের আয়ের অন্যতম উৎস টিউশনি হারিয়েছেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অনেকের অভিভাবকদেরও আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। যে ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা-মা শ্রমজীবী, ছোট দোকান চালান, বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন তারা পরিবারের সদস্যদের খাবার সংগ্রহ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাবে। যেটা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন আজকে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেক ভালো আছেন তাদের কিন্ত অনেকেরই আছে নিদারুণ কষ্টের ইতিহাস।এদের অনেকেই ইতিহাস মনে রাখে ও সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে। আবার অনেকেই আছেন বেমালুম বেড়ে ওঠার ইতিহাস ভুলে যান। সবার প্রতি বিশেষ অনুরোধ কিভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছেন অনুগ্রহ করে একটু চিন্তা করেন। আপনি হয়তো ভালো ছিলেন কিন্তু আপনারই সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র কিভাবে তাদের শিক্ষা চালিয়ে নিয়ে গেছেন,কত কষ্ট তাদের সইতে হয়েছে তা কি তখন ভেবেছেন বা এখন ভাবেন? শিক্ষার্থীদের বাসে হাফ ভাড়া দেওয়া নিয়ে কত ঘটনা ঘটে কিন্তু কখনো কি আমরা ভাবি ওরা কেন হাফ ভাড়া দেয়?আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমরা ও হাফ ভাড়া দিয়েছি নিতান্তই বাধ্য হয়েই দিয়েছি।
শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরর বেতন, বাড়ি ভাড়া ও খাবারের পেছনে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ দুর্যোগকালীন সময়ে বেতনের বা আনুষঙ্গিক খরচের বিষয়টি ছাড় বা কমানোর ব্যাপারে ভাবতে পারে। পাশাপাশি সরকার আর্থিক সহায়তা ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা লাঘব করতে পারে। ইতিমধ্যে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে নির্দেশনা দিয়েছেন যারা বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করতে পারবেনা তাদের উপর যেন চাপ প্রয়োগ না করা হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি ব্যয়ের খাত হচ্ছে বাড়ি ভাড়া। গত ১৮ ই মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ইতিমধ্যে দুই মাসের ভাড়া বকেয়া হয়ে গেছে। মে মাস গেলে তিন মাস বকেয়া হয়ে যাবে। যা বহন করা শিক্ষার্থী দের জন্য এই দূর্যোগকালীন সময়ে অনেক বড় চিন্তার কারণ। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় কিছু বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া মওকুফের চিন্তা করছেন। আবার অনেক জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের সাথে বাড়িওলারা আলোচনায়ও বসে নি। আবার কোথাও ভিক্ষা করে ভাড়া পরিশোধ করতে বলেছে!! সবই ঘটছে বিচ্ছিন্নভাবে। এখন প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে একটি মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন। এইসময়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীরা এগিয়ে এসেছেন তুলনামূলক পিছিয়ে পড়াদের সাহায্য করতে।তারা খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। বাড়িওয়ালারা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
সুতরাং তারা ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াবেন এটাই প্রত্যাশিত। এই ছাত্র-ছাত্রীরাই হয়তো তাদের কারোরই ভাই, বোন বা কোন আত্মীয়। তারা ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসলে দেশে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসে বাড়ির মালিকদের সাথে কথা বলে ছাত্রদের কল্যানে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে ছাত্র সমাজ আশা করে। বর্তমান সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে বিভিন্ন দুর্যোগ কিভাবে সফল ভাবে মোকাবেলা করতে হয়। বর্তমান করোনা জনিত দুর্যোগ ও সফলভাবে মোকাবেলা করে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করতে সমর্থ হবেন। এখানে উল্লেখ্য আজকের শিক্ষার্থীরা আগামীর ভবিষ্যৎ, আগামীর বাংলাদেশ।তাদের হাত ধরেই এদেশ সুখী, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা হবে। তাই তাদের কল্যাণে শিক্ষা ব্যায় ও বাড়ি ভাড়ার মানবিক ভাবনার বিকাশ ঘটাতে হবে।
লেখকঃ মোঃ হাফিজুর রহমান, শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।