নূরুন্নবী সবুজ
যারা সরকারী কমর্মচারী তারা যে সব সময় প্রমোশন পান এমনটি নয় । মাঝে মাঝে তাদের ডিমোশনও হয়ে থাকে। এমন কিছু ঘটনাও দেখা যায় যেখানে একজন যোগ্য ব্যাক্তি থাকা সত্ত্বেও আর একজনের প্রমোশন হয়েছে। বা যার যে পদে থাকা উচিত তাকে সে পদে না রেখে অন্য স্থানে রাখা হয়েছে। বিশেষ কারনে সরকারী চাকুরি হতে বরখাস্ত হবার ঘটনাও কম না। প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের চাকুরীতে নিযুক্ত কেউ যদি এই অবস্থার স্বিকার হয় সে কিভাবে প্রতিকার পাবে সে সমন্ধে আইনের বিধান গুলো আমাদের কাজে দিবে। প্রতিকার: ‘ আপনি সাংবিধানিক ভাবে ও প্রচলিত আইনের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারেন। আমরা সবাই জানি মেীলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে যে কেউ রিট করতে পারে। আপনার সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রেও যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে যা মেীলিক অধিকারের লঙ্ঘন তাহলেও আপনি রিট করে প্রতিকার পেতে পারেন। রিট করা হয়ে থাকে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদের আলোকে।এটি আপনার বাড়তি সুবিধা হিসেবে থাকলো।
এর বাইরেও আপনার মামলা করার অধিকার আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১১৭-এ প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের কথা বলা হয়েছে। এই ট্রাইবুনালই মূলত আপনার অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করবে। এই অনুচ্ছেদ সরাসরি অধিকার রক্ষার পদ্ধতি তুলে ধরেনি। অনুচ্ছেদ টি প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের চাকুরীতে নিযুক্ত ব্যাক্তিদের সাহায্য , বা শাস্তি দেওয়া বা কাজের শর্তাবলী কি হবে তা নির্ধারণ করার জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করার অনুমতি দেয়। আবার কোন রাষ্ট্রয়াত্ত কোন উদ্যোগ বা সরকারী কতৃপক্ষ কিভাবে পরিচালিত হবে তার জন্য ট্রাইবুনাল গঠনের কথা বলেছে। ১১৭ নং অনুচ্ছেদ যে অধিকার দেয় তার ভিত্তিতে ১৯৮০ সালে সরকারী কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে একটি আইন তৈরী করা হয়। এই আইনের নাম “প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল, ১৯৮০.” আমরা এখন এ আইনের বিধি বিধান সমন্ধে জানবো।
এই আইন অনুযায়ী সারা বাংলাদেশে ২ টি ট্রাইবুনাল আছে। একটি বগুড়ায় আর অপরটি ঢাকায়। বগুড়ার সাথে যুক্ত আছে ২৩ টি জেলা। যথা; বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ , দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারি, রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগা, নাটোর, যশোর ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর। এই ২৩ টি বাদে বাকী জেলাগুলো ঢাকার অধীনে। তবে আর একটি বিষয় হলো পার্বত্য চট্রগ্রামের ৩ টি জেলা, যথা; রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের আওতার বাইরে।গল্পে গল্পেট্রাইবুনাল গঠন: প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল গঠিত হবে ১ জন সদস্য নিয়ে। আর তিনি জেলা জজ সম-মর্যাদার একজন হবেন।জেলা জজ সম-মর্যাদার বাইরে কেউ এ ট্রাইবুনালে সদস্য হবার যোগ্য হবেন না।(ধারা-৩) প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের এখতিয়ার: এই ট্রাইবুনাল কোন কোন মামলার নিয়ে কাজ করবে তা এই আইনের ৪ নং ধারায় উল্লেখ করা আছে। ৪ নং ধারায় মূল যে কথা গুলো বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সকল কর্মচারী ও সংবিধিবদ্ধ সরকারী সংস্থায় যারা কর্মে নিযুক্ত তার তাদের পেনশন ও চাকুরীর শর্তাবলী বা তার বিরুদ্ধে যদি কোন কার্যধারা গ্রহন করা হয় সে বিষয় নিয়ে ট্রাইবুনালে মামলা করতে পারবে ।
আর এই মামলাগুলো এই ধারা অনুযায়ী অবশ্যই এই ট্রাইবুনালেই করতে হবে। প্রশাসনক ট্রাইবুনাল আইন, ১৯৮০ এর ১১ ধারাতেও বলা হয়েছে , অন্য কোন আইনে যাই থাকুক না কেন এ আইনের বিধানগুলো প্রাধান্য পাবে। সহজ কথায় উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে মামলা অবশ্যই প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে করতে হবে।গল্পে গল্পেপ্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনাল: প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল যে রায় দিবেন তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনালে । প্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনালের সদস্য হবেন ৩ জন। এতে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন যার যোগ্যতা হবে সুপ্রিম কোর্টর হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বা অবসর প্রাপ্ত বিচারক বা এমন ব্যাক্তি যিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হবার যোগ্যতা রাখেন। আর সদস্য গণ হবেন যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার কেউ তবে সর্বনিম্ন যোগ্যতা হবে জেলা জজ। জেলা জজ পদমর্যাদার নিচে কেউ আপিল ট্রাইবুনালের যোগ্য হবেন না। ( ধারা ৫)। ১০ক ধারায় দেখা যায় আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের যেরূপ এখতিয়ার প্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনাল বা ট্রাইবুনাল সেরূপ এখতিয়ার ভোগ করতে পারেন। যে কারো এই ট্রাইবুনালের অবমাননা করার অনুমতি বা সুযোগ নেই। ৮ নং ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট পক্ষদের মাঝে বাধ্যকর করা হয়েছে।
প্রশাসনিক ট্রাইবুনালকে আরো বেশী কার্যকরী ও নির্ভরযোগ্য করতে ৯ ধারায় বলা হয়েছে আইন সংগত কারন ব্যাতিত যদি ট্রাইবুনালের কোন কার্যক্রমে বাধা দেয়া হয় তাহলে তার ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড হতে পারে পাশাপাশি ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। আবার আদালত কারাদন্ড ও জরিমানা শাস্তি একসাথেই দিতে পারে। ১০ নং ধারায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলা হয়েছে যেটিও এই ট্রাইবুনালের সক্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। এই আদালতে যে আদেশ, সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে তা অন্য কোন আদালত দ্বারা যে কোন ভাবে যাচাই করা যাবে না। যেমন তর্কিত, পুনর্বিবেচনা, বাতিল বা প্রশ্নবিদ্ধ করা।গল্পে গল্পেপ্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনালের এখতিয়ার: ট্রাইবুনালে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি আপিল ট্রাইবুনালে মামলা করা যাবে। এক্ষেত্রে তামাদি হবে ৩০ দিন। তবে ৩০ দিন পার হলেও তামাদির ২য় সুযোগ হিসেবে ৬০ দিন করা হয়েছে। ২য় তামাদির ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ত কারন দেখাতে হবে।
আপিল ট্রাইবুনালে প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের দেয়া সিদ্ধান্তে যে কোন কিছুর রদ, পরিবর্তন বা সংশোধন হতে পারে। (ধারা ৬) সংবিধানের ১০৩ নং অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের এখতিয়ার তুলে ধরা হয়েছে। ১০৩ নং অনুচ্ছেদের ক্ষমতাগুলো বা কাজ হাইকোর্টের উপর যে ভাবে প্রযোজ্য হয প্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনালেও সেভাবে প্রযোজ্য হবে। ( ধারা ৬ক) ট্রাইবুনালের ক্ষমতা: ⎯(১) আপীল বা, ক্ষেত্রমত, আবেদনের শুনানীর উদ্দেশ্যে, দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ (১৯০৮ সনের ৫ নং আইন) এর অধীন কোন মামলা বিচারের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের নিম্নবর্ণিত বিষয়ে দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতা থাকিবে, যথা ঃ⎯ (ক) কোন ব্যক্তিকে সমন দ্বারা আদালতে হাজির হইবার জন্য সমন জারী এবং তাহাকে আদালতে হাজির হইবার জন্য বাধ্য করা এবং শপথপূর্বক তাহাকে পরীক্ষা করা; (খ) প্রয়োজনে যে কোন দলিল উদ্ধার ও উপস্থাপন করা; (গ) প্রয়োজনে শপথপূর্বক সাক্ষ্যগ্রহণ করা; (ঘ) কোন অফিস হইতে সরকারী দলিলপত্র বা উহার কোন অনুলিপি তলব করা; (ঙ) সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ বা কোন দলিলপত্র পরীক্ষা করিবার জন্য কমিশন গঠন করা; (চ) আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন বিষয়। (২) ট্রাইব্যুনালের কোন কার্যপদ্ধতি দণ্ডবিধি (১৮৬০ সনের ৪৫ নং আইন) এর ধারা ১৯৩ এ সংজ্ঞায়িত অর্থে বিচারিক কার্যপদ্ধতি হিসাবে গণ্য হইবে। (৩) সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থান বা স্থানসমূহে ট্রাইব্যুনাল বসিবে (৩ক)প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের সদস্যগণের মধ্যে মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রাধান্য পাইবে।
(৩খ) যদি, শুনানী চলাকালিন চেয়ারম্যান বা প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের যে কোন সদস্য যে কোন কারণে উহার কোন শুনানীতে যোগদান করিতে অক্ষম হন, তাহা হইলে উক্ত শুনানী অন্য দুইজন সদস্যের সম্মুখে অব্যাহত থাকিতে পারিবে। (৪) ও (৫) [প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ (১৯৮৩ সনের ৩৮ নং অধ্যাদেশ) এর ধারা ৩ দ্বারা বিলুপ্ত।] (৬) ট্রাইব্যুনালের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য অথবা প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যেরূপ প্রয়োজন মনে করিবেন সেইরূপে প্রশাসনিক বিন্যাস করিতে পারিবেন। (৭) প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনাল, লিখিত আদেশ দ্বারা, যে কোন মামলার চলমান কার্যক্রমের যে কোন পর্যায়ে, উহা এক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল হইতে অন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করিতে পারিবে। ৫৯৪০ বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, সেপ্টেম্বর ২২, ২০০৮ (৮) এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, ট্রাইব্যুনাল কোন আপীল বা, ক্ষেত্রমত, দরখাস্ত শুনানীর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করিবে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই আইন দ্বারা বা এই আইনের অধীন প্রণীত কোন বিধি দ্বারা কোন বিষয়ে এইরূপ কোন পদ্ধতি নির্ধারিত না হইয়া থাকিলে, ট্রাইব্যুনাল তৎবিষয়ে প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রণীত পদ্ধতি অনুসরণ করিবে। আবেদনকারীর মৃত্যু: আবেদনকারী প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে আবেদন করে মারা গেলে তা বাতিল হতে পারে। তবে যদি তিনি পেনশন পাবার যোগ্যে হন তাহলে তার মারা যাবার পর যিনি তার পেনশন পাবেন তিনি মামলার পক্ষ হবে। ৬০ কার্য দিবসের মধ্যে ট্রাইবুনাল বা আপিল আদালতে আবেদন করে তিনি পক্ষ ভূক্ত হতে পারবেন। ( ধারা ৭ক ) আবেদন সংশোধন: ট্রাইবুনাল চলাকালীন যে কোন সময় ট্রাইবুনাল আবেদন সংশোধনের অনুমতি দিতে পারেন। ( ধারা ৭খ) সরকারী কর্মচারী হিসেবে ও রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে যেন একজন ব্যাক্তি তার সেরা কাজ নিরপেক্ষতার সাথে দিতে পারে তার জন্য এই বিধান বিশেষ কাজে দেয়। চাকুরীর সুরক্ষার জন্য এই আইনের বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। তবে এই আইনের অধীন ট্রাইবুনালের সংখ্যা আরো বাড়ানো যায় কিনা সেটি নিয়ে এখন ভাবার সময়। অনন্ত প্রত্যেক বিভাগে এই ট্রাইবুনাল হলে অনেকের জন্য প্রতিকার আরো সহজলভ্য হবে।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট। mdnurunnobiislam379@gmail.com