এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আইন, আদালত, বিচার ব্যবস্থা, বিচার পদ্ধতি ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে আইনজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। আইনজীবীদের অনুপস্থিত বিচারবিভাগ মৃত সন্তানের ন্যায়। বিচারক ও আইনজীবী বিচার ব্যবস্থায় একে অপরের পরিপূরক। বিচারকদের জন্য রয়েছে সুরক্ষা আইন। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। অথচ বিচারিক ও সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইনজীবীর হাতে পড়ছে হাতকড়া। টিসিবি’র পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বরিশাল জজ কোর্টের আইনজীবী রবিউল ইসলাম রিপনকে সাজা দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমূল হুদা। ২ মে, শনিবার এ সাজা দেওয়ার সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেট বলেন ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’।
বাংলাদেশে বলবৎ ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৯৭ ধারায় জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট তথা সরকারি চাকুরীজীবীদের দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ করলে মামলা করার জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ পত্র দাখিলের আগে সরকারের বা নিয়োগ কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেফতার করা যাবেনা। অথচ আইনজীবীদের গ্রেফতারে কোন সুরক্ষা আইন নেই। আইনজীবীদের গ্রেফতারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুমতি এখন সময়ের দাবী মাত্র। আইনজীবী ব্যতীত বিচার বিভাগ ও ন্যায়বিচার যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব।
আইন করে বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তির একটি অপসংস্কৃতি অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে চলছে। এই অপসংস্কৃতির শুরু মুক্তিযুদ্ধের রাজাকার-আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাদের বিচার না করার মাধ্যমে।। ইনডেমনিটি হলো কোনো বিচারকার্যকে বাধা প্রধান সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সকল প্রকার সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩ ফেব্রæুয়ারি ২০০৩ ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩’ নামে সবশেষে ইনডেমিনিটি আইন পাস হয়। বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না। বলে রাখি এ সবকিছুর আগে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের সকল বেআইনি এবং অসাংবিধানিক কাজের দায়মুক্তি প্রদান অধ্যাদেশও জারি করা হয়।
এবার আসি দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে রাহুর মতো চেপে আছে। এর একটি ২০১০ সালে প্রথমে চার বছরের জন্য বহাল করা হয়, এরপর তার মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সকল প্রকল্প দরপত্র ছাড়া, বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক আদালতের দারস্থ হতে পারবে না। এই দায়মুক্তি আইনের জোরেই কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া একের পর এক অসম্ভব ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।
আরেকটি দায়মুক্তি আইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালে। এই আইন অনুযায়ী এই প্রকল্পে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয় তার দায় কোম্পানি বা কোনো কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, জনস্বার্থ নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দায়মুক্তি আইনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সকল তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের দায়মুক্তি আইন প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টাকা পাচারের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যই করা হয়েছে।
এরপর রয়েছে আমানত সুরক্ষা আইন। ব্যাংকে যত টাকা জমা রাখেন না কেন, ক্ষতিপূরণ পাবেন সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা! বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘আমানত সুরক্ষা আইন’র প্রস্তাবনায় এ কথা লেখা আছে। একজন গ্রাহক হয়ত ব্যাংকে রেখেছেন পাঁচ লাখ টাকা, আরেকজন হয়ত রেখেছেন পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে উভয়ের অবস্থান সমান, পাবেন এক লাখ টাকা করে।
এ সরকারে দীর্ঘ সময়ে ‘রাজনৈতিক মামলা’ বলে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েক হাজার মামলা থেকে সরকারি দলের লোকজনকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর এখন চলছে দুদকের দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার খেলা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে সরকার নিজেদের লোকজনের দায়মুক্তি দেওয়ার একটা খুব ‘চালাকি’পূর্ণ কৌশল বের করেছে।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, আইনজীবীর উপর আক্রমণ, অত্যাচার নির্যাতন বেড়েই চলছে। যেহেতু আদালতে বিচার প্রার্থী বিবাদ মান পক্ষদের নিয়ে আইনজীবীদের কাজ করতে হয়, তাই সাধারণভাবে একটা ঝুঁকির বিষয় থেকেই যায়। ইদানিং দেখা যায়, মামলার প্রতিপক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে উকিলের উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। এই প্রতিশোধের মাত্রা হুমকি, অপহরণ, এমনকি হত্যাকাÐ পর্যন্ত গড়ায়। উকিলের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, উকিলের পরিবারের উপরও তাঁরা চড়াও হয়। আর এর মূল্য দিতে হয়, উকিলকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পাতা আছে কিনা যাহাতে লিখা “খুনিদের বিচার করা যাবে না”! সেটা আমাদের দেশেই সম্ভব। কাজেই বিজ্ঞ আইনজীবী ভাইদের উদ্দেেেশ্য বলছি, আগে নিজেদে নিরাপদ করুন, তারপর অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবুন। সময় এসেছে আওয়াজ তুলুন। নতুবা এর খেসারত আইনজীবী সমাজকে দিতেই হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮